1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয় কেন এমন?

এ কে এম খাদেমুল হক
৩ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজের অংশ গ্রহণ নতুন কিছু নয়৷ ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাই এ দেশের সকল ঐতিহাসিক অর্জনের পথ দেখিয়ে এসেছেন, রাজপথের সৈনিক হিসেবে সরব থেকেছেন সব সময়৷

https://p.dw.com/p/43lwa
ছবি: bdnews24.com

বাসভাড়ায় শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধার দাবিতে ঢাকার রাজপথে গত কয়েকদিন ধরে চলমান ছাত্র-বিক্ষোভ দেখে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ এই আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয়ও অর্জিত হয়েছে এরই মধ্যে, বিআরটিসির সরকারি বাসে তো বটেই বেসরকারি মালিকানাধীন বাস কোম্পানিগুলোও শিক্ষার্থীদের কাছে অর্ধেক ভাড়া নিতে রাজি হয়েছে৷ নানা শর্তের বেড়াজালে আটকানো সেই ঘোষণা অবশ্য সন্তুষ্ট করতে পারেনি তাদের, আন্দোলনও থামেনি তাই৷

শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহণে বিশেষ সুবিধার দাবিটাও একেবারে অচেনা নয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নানা রূপে এই সুবিধা পেয়ে থাকেন শিক্ষার্থীরা৷ কোথাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়া ট্র্যাভেল কার্ড ব্যবহার করে বিনাভাড়ায় ভ্রমণের সুযোগ থাকে, কোথাও বা থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যের বিশেষ টিকেট ক্রয়ের ব্যবস্থা৷ মোট কথা, ভবিষ্যতের করদাতা নাগরিক হিসেবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার আগে শিক্ষার্থীদের জন্য গণ-পরিবহণ ব্যবস্থায় কিছুটা সুবিধা দেয়াই ‘সভ্য সমাজের’ রীতি৷ তবে ‘সভ্য সমাজের’ অন্য অনেক রীতির মতোই এ রীতিটিও আমাদের এই দেশে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি কখনোই৷ রাজধানীর কোনো কোনো রুটে এক সময় হাফ-ভাড়ার প্রবর্তন থাকলেও এ নিয়ে বাসশ্রমিকদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হতো সব সময়৷ আর সাম্প্রতিককালে তো উঠেই গিয়েছিল এই প্রথা৷

দাবিটা কিন্তু নতুন নয়! এই ভূখণ্ডের প্রথম সত্যিকারের ছাত্র আন্দোলন হিসেবে পরিচিত ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম একটি দাবি ছিল গণ-পরিবহণে শিক্ষার্থীদের ‘অর্ধেক ভাড়া নিশ্চিত করা৷ ছয় দশক পরে, স্বাধীন বাংলাদেশে এসে সেই পুরোনো দাবি নিয়ে আবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে হচ্ছে, এটাই আসলে লজ্জার ব্যাপার৷ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে তাই সংশয়ের অবকাশ নেই৷

কিন্তু এই আন্দোলন, এবং সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে সফল হওয়া আন্দোলনগুলোর গতি-প্রকৃতি অনুসরণ করলে বিষয়টিকে মোটেই এমন সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই৷ হাফ-ভাড়ার আন্দোলন চলার মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু চলমান আন্দোলনটির রূপ বদল করে পরিণত করেছে নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনে৷ বছর দুয়েক আগে ঠিক এ রকমই একটি আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল ঢাকার রাজপথ৷ আর তার কিছুদিন আগে সারা দেশেই সাড়া ফেলেছিল সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা অন্য একটি আন্দোলন৷ ওই আন্দোলনগুলোতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশ গ্রহণ ছিল লক্ষ্যণীয়৷ তাদের অনেকেই এসেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে৷ কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে, আন্দোলন যেন শেষ হতেই চায় না৷ যে দাবিতে বিক্ষোভের সূচনা, তার বেশিরভাগ অর্জিত হলেও সন্তুষ্ট হচ্ছেন না তারা, নানা ছুতোয় তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ অন্য দিকে এই দীর্ঘসূত্রিতার এক পর্যায়ে ছাত্রদেরই অন্য একটি অংশকে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে এই আন্দোলন বানচাল করার কাজে৷

দুটি প্রবণতাই মারাত্মক৷ গণতান্ত্রিক সমাজে অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে অনুভব করলে শিক্ষার্থীসহ যে কোনো গোষ্ঠীর শ্রেণি, পেশা বা অন্য কোনো সূত্রে সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা এবং তার মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে যাওয়াই রীতি৷ কিন্তু, সেই চেষ্টারও একটা সীমা থাকে৷ বিক্ষোভের নামে অন্যদের ক্ষতি সাধন করার অধিকার কারো নেই৷ কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, কিংবা সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকটি বাস জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনাকে কোনোক্রমেই আন্দোলনের উপযুক্ত কৌশল বলে বিবেচনা করা যায় না৷ তেমনি আন্দোলনরতদের ওপর হেলমেট-হাতুড়ির আক্রমণও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ দুইপক্ষের অবাঞ্ছিত আচরণ প্রশ্ন জাগায়- তাহলে কি তারা অন্য কোনো পক্ষের ক্রীড়নক হয়ে উঠছেন? পেছন থেকে আসলে কলকাঠি নাড়ছেন অন্য কেউ?

শিক্ষার্থীদের যে ঐতিহাসিক আন্দোলনে এই হাফ-ভাড়ার দাবি প্রথম উঠেছিল, সেই আন্দোলনের চরিত্র কিন্তু এরকম ছিল না৷ সে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল আসলে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সংক্রান্ত দাবিকে ঘিরে৷ হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে গৃহীত কালা-কানুন এবং শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরোধিতাই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য, তার সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের অধিকারসংক্রান্ত নানা দাবি-দাওয়া৷ সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এরকম আন্দোলন মোটেই গড়ে উঠছে না৷ এরকম ইস্যুর কিন্তু অভাব নেই৷ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা রকম অব্যবস্থাপনার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা, বিশেষ করে ডাইনিং-ক্যান্টিনের খাবারের মান নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি, সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতির মূল সুরকে উপেক্ষা করে পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রচলন ও তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলাদা প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের তুঘলকি প্রচেষ্টা, কিংবা শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে কখনো সৃজনশীল কখনো একমুখি শিক্ষা চালুর প্রচেষ্টা- একেবারে অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যুর অভাব নেই৷ অভাব নেই সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুরও, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে লুট-পাট, কত ইস্যু!

এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকছবি: Mohammad Rabbani

কিন্তু এসব নিয়ে কোনো পক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই; কেবল কদিন পর পর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো তাৎক্ষণিক সাড়া জাগানো ইস্যু নিয়ে জমে উঠছে আন্দোলন, তাতে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে রাস্তায় নেমে নতুন জনদুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করছে শিক্ষার্থীরা৷ পরিবহণ সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর মতোই জনদুর্ভোগকে পুঁজি করে দাবি আদায়ের কৌশল গ্রহণ করছে তারা৷ ফলে সরকার সমর্থকরাও সুযোগ পাচ্ছে আন্দোলনের ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করার; দমন-নিপীড়নের কূটকৌশল গ্রহণ করার পাশাপাশি তারা চালাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে প্রচারণার সাইবার-যুদ্ধ৷ দেখে-শুনে মনে হতেই পারে, শিক্ষার সুযোগ পেয়ে নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পথের অভিযাত্রী শিক্ষার্থীরা আজ তাদের পূর্বসুরীদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারছে না; তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছে কেউ কেউ৷ নেপথ্যের এই খেলায় নাটাইটা শেষ পর্যন্ত অন্যদের হাতে থাকছে বলেই অনেক আশার আলো দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত নিভে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় আন্দোলনগুলো; হয়ে উঠতে পারছে না পথের দিশারী৷