শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বাড়ছে?
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২‘‘আমি যদি বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারতাম, তাহলে এটা হতো না৷ এখন আমি অধঃপতিত হলাম৷ আমি আপনাদের কাছে একদম ক্ষমার অযোগ্য, তবুও সবার কাছে ক্ষমা প্রর্থনা করছি৷’’
এমন একটি চিরকুট লিখে গত জানুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অনিক চাকমা৷
সারাদেশে গত ৮ মাসে আত্মহত্যা করেছেন তিনশ ৬৪জন শিক্ষার্থী৷ আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে একশ একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ জরিপটি বলছে, ২০১৮ সালে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১১জন এবং তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১৯জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০২০ সালে দেশে ৪২জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ আর চলতি বছরের ৮ মাসেই আত্মহত্যা করেছেন ৫০ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী৷
আত্মহত্যার এই প্রবণতা সমাজের নানা স্তরের মানুষের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে৷ সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার এই প্রবণতা বাড়ছে৷ আর দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে৷
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রণে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে৷ শিশু বয়স থেকেই মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷ করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে৷ রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশোনার চাপ৷ এছাড়া পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে৷ শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বাড়ছে৷’’
আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এ বছরের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করা তিনশ ৬৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে একশ ৯৪ জন (৫৩ দশমিত ৩০ শতাংশ) স্কুলের৷ কলেজ শিক্ষার্থী ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং মাদ্রাসার ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ৷ ২০২১ সালে ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল৷ আর নতুন তথ্য বলছে, ছাত্রীদের মধ্যে এই হার বেশি৷ এবছর আত্মহত্যা করা ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশই (২২১ জন) ছাত্রী৷ বাকি ১৪৩ জন ছাত্র৷
শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপকে আত্মহত্যার হার বাড়ার অন্যতম কারণ মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হচ্ছে৷ কোভিডের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এমনতেই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে৷’’
তার মতে, করোনার দুই বছর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু মানসিকভাবে তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে না৷
নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণণা দিয়ে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আমার কাছে বলেছে, তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছে পরিবারের চাপ৷ এত চাপ তাদের সামাল দেওয়ার মানসিক অবস্থা তো থাকতে হবে৷ ফলে হতাশা থেকেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে৷’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বে সার্বিকভাবে মৃত্যুর ১৭তম প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা৷ অবশ্য ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ আত্মহত্যা৷ বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন৷ এ হিসেবে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন৷ যদিও দারিদ্র্য সরাসরি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িত নয়, তবে এটি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়৷ ডব্লিউএইচও'র এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যা করে তার ৭৭ শতাংশই হয়ে থাকে কম আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, জন্মের পর থেকে জীবনধারনের দক্ষতা চর্চার বিষয় পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা উচিত৷ যোগব্যায়াম, মননশীলতার অনুশীলন, চাপ ব্যবস্থাপনা, রাগ ব্যবস্থাপনা, সহানুভূতি, নিজের যত্ন নেওয়ার মতো বিষয়গুলো থাকা উচিত৷
এই অধ্যাপক আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের ওপরও জোর দেন৷
তার মতে, মানুষ হতাশ হলে খুব ছোট কারণেও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না৷ তখন নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ এজন্য আশপাশের মানুষদের ব্যাপারে সবাইকে অনেক বেশি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে৷
শনিবার সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস৷ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার৷ এ লক্ষ্যে সামাজিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)৷ এতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা৷
গত চার বছরে আত্মহত্যা ঠেকাতে নানা সময়ে কাজ করতে দেখা গেছে জাতীয় জরুরি সেবা হটলাইন ৯৯৯-এর সদস্যদের৷ বিভিন্ন সময়ে ফোন পেয়ে তারা ছুটে গেছেন ভিকটিম উদ্ধারে৷
৯৯৯-এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘‘আমরা এই সময়ে দেড় হাজার আত্মহত্যা ঠেকিয়েছি৷ ৯৯৯ হচ্ছে জরুরি সেবা৷ আমাদের কাছে অনেক সময়ই আত্মহত্যা চেষ্টার তথ্য জানিয়ে কল এসে থাকে৷ অনেক সময় ভিকটিম নিজেই কল দিয়ে আমাদের কাছে জানান যে, তিনি পারিবারিক কিংবা কোনো খারাপ লাগার কারণে এই কাজ করছেন৷ এক্ষেত্রে আমরা কৌশলে তার অবস্থান জেনে নিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করে থাকি৷ এছাড়া অনেক সময় প্রতিবেশী কিংবা ভিকটিমের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কল দিয়ে আমাদের জানান৷ এক্ষেত্রে আমরা ভিকটিমের অবস্থান জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি৷’’
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমাজে যখন প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়, মানুষের মনে চাপ বাড়ে, জীবন ধারণের চাপ বাড়ে তখন আত্মহত্যা করে৷ কিন্তু আত্মহত্যাটা এক ধরনের অপরাধ৷ কারণ একটা জীবনকে শেষ করে দেওয়া আমাদের দেশের সমাজ ও আইন সেটাকে বৈধতা দেয়নি৷ আত্মহনন করলে পরিবার ও সমাজে একটি বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ এতে সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়৷’’
আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরে অধ্যাপক জিয়া বলেন, ‘‘পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না৷ প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যেন সংগ্রাম করতে না হয়৷ পারিবারিক বন্ধনটা যেন থাকে৷ কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে৷ সামাজিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না৷ খেলাধুলা, সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে সম্পৃক্ত থাকা, সৃজনশীল কাজে যত বেশি যুক্ত হওয়া যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে৷’’