‘শিশুরা অপরাধ করে না, ভুল করে’
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে, চলে অবরোধ-হরতাল, তখন এই শিশুদের কদর বেড়ে যায়৷ রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ধরণের কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিশুরাই যেন প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়৷ তবে এ অবস্থা আজকের নয়, বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে৷
রাজনৈতিক কর্মসূচি যখন রাজনৈতিক হয়, তখন যেমন শিশুদের ব্যবহার করা হয়, তেমনি এর অরাজনৈতিক, মানে নাশকতামূলক কাজে শিশুদের কদর আরো বেশি৷
২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকার শাপলা চত্তরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল৷ এছাড়া পুলিশি অভিযানের সময় এই শিশুরাই আহত হয়েছে বেশি৷ অথচ যারা তাদের ব্যবহার করেছে, তারা আগেই পালিয়ে গেছে৷
অস্থির সময়ে বড় বড় রাজনৈতিক দলের মিছিলের আগেও থাকে শিশুরা৷ এটা বাংলাদেশে বহুদিনের রাজনৈতিক ‘কালচার'৷ প্রকৃত অর্থে তারাও শিশুদের মিছিলের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন৷ এটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়৷
তখন অবশ্য শিশুদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠে থাকতেন৷ কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় অজ্ঞাত স্থান থেকে, বিবৃতির মাধ্যমে৷ কর্মসূচি চলাকালে এবং কর্মসূচি ঘোষণার পর চোরাগোপ্তা ককটেল, পেট্রোল বোমা হামলা বা বাসে আগুন ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা যায় না৷ তাই এ সব নাশকতার কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হয় নিরাপদ ‘ক্যারিয়ার' হিসেবে৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা নাকি এখন রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ছিন্নমূল এবং বস্তিতে বসবাসরত শিশুদের ওপরই বেশি নজর রাখছেন৷ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান অবরোধ-হরতালের সময় শিশুদেরই ককটেল, পেট্রোল বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন ও তা নিরাপদে রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে৷''
তিনি জানান, ‘‘গত দেড় মাসে ককটেল বোমা ছোড়ার সময় অথবা বহনের সময় অন্তত ২০টি শিশুকে আটক করা হয়েছে৷ তবে আটকের পর তারা তাদের এ সব কে দিয়েছে, তা ঠিকমত বলতে পারে না৷ তারা টাকা পেয়েছে তাই কাজ করেছে৷'' এর বাইরে কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ধর্মের নামে শিশুদের নাশকতার কাজেও উদ্বুদ্ধ করে বলে জানান তিনি৷ তিনি জানান, এই শিশুদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে৷
গত ১২ই ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে পুলিশের হাতে আটক হয় দু'টি শিশু৷ তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে৷ তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং ম্যাগজিন ভর্তি ৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ৷ পরে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে আরো তিনটি বিদেশি পিস্তল এবং একাধিক ম্যাগজিন এবং তাজা গুলিও উদ্ধার করা হয়৷
এই দু'টি শিশুর সঙ্গে কথা বলে পুলিশ যা জানতে পেরেছে, তা ভয়াবহ৷ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা এ নিয়ে আলাপকালে জানান, বস্তিতে বসবাসরত নিম্নবিত্ত শিশুদেরই অপরাধমূলক কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কখনো কখনো বস্তির মালিকরাই শিশুদের বাধ্য করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক ব্যবসায়৷ অধিকাংশ বস্তিতেই মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো হচ্ছে শিশুরা৷ শিশুদের নাকি দিনে এ সব কাজের জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা দেয়া হয়৷
ঐ কর্মকর্তা জানান, ‘‘বড় বড় অপরাধের সাথে শিশুদের জড়িয়ে ফেলার প্রধান কারণই হচ্ছে নিরাপত্তা৷ শিশুদের ব্যবহার করে অতি সহজে সন্ত্রাসীরা পার পাওয়ার চেষ্টা করে৷ মাদক এবং আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন ও লুকিয়ে রাখতে শিশুদেরই সবচেয়ে নিরাদ মনে করে তারা৷ কারণ শিশুরা জানেও না তারা কার অস্ত্র জমা রাখছে, বহন করছে বা কার জন্য ককটেল ছুড়ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো বস্তি মালিক অথবা নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমেই অর্থের বিনিময়ে শিশুদের কাজে লাগায়৷''
বাংলাদেশে শিশুদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এছাড়া শিশুদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করারও আইন আছে৷ আইনে বলা আছে, শিশুরা (১৮ বছর পর্যন্ত) আটক হলে থানা থেকে আদালতে পাঠানোর সময় পুলিশ কাগজপত্রে তাদের নাম, বয়স এবং পরিচয় লাল কালিতে লিখবে, যাতে বিচারক দেখেই আটককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ তাকে কিশোর আদালতে পাঠাতে পারেন৷ আর আইনে তাদের শাস্তি নয়, সংশোধন করার জন্য কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর বিধান আছে৷
শুধু পুলিশ নয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরেরও দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে৷ প্রত্যেক থানা এলাকায় একজন করে ‘প্রবেশন' অফিসারের পদ আছে৷ তাদের দায়িত্ব হলো থানার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আটক শিশুদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা৷
কিন্তু পুলিশ বা সমাজসেবা অধিপ্তর কেউই এই দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না৷ পুলিশ শিশুদের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে 'দাগি অপরাধী' ধরার কৃতিত্ব নেয়৷ অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান৷
এই সুযোগে মূল অপরাধীরা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ যারা শিশুদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেন, তাদের শাস্তি তো দূরের কথা চিহ্নিতই করা হয় না৷ অথচ আইনে এই ‘গডফাদাররাই' অপরাধী৷ তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান আছে৷
তাছাড়া সবার উপরে যারা দেশের জন্য রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন, সেই রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে শিশুদের নাশকতায় ব্যবহার করে? কে এর জবাব দেবে?
১০ বছর আগের কথা৷ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলাম শিশু আইন এবং শিশুদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে৷ সেই প্রশিক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ আরো কয়েকটি দেশের বর্তমান এবং সাবেক বিচারকরা ছিলেন প্রশিক্ষক৷ আমার কাছে বাংলাদেশে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের প্রতি পুলিশ ও আইনের আচরণ শুনে তারা শিউরে ওঠেন৷ আমাকে তাঁরা বলেন, ‘‘শিশুরা অপরাধ করে না, তারা ভুল করে৷ তাই তাদের সংশোধন করে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করাটাই আইনি দায়িত্ব৷ তাদের জীবনকে অন্ধকরে ঠেলে দেয়া নয়৷''
ঐ কর্মশালাতেই মৌরিন নামে শ্রীলঙ্কার শিশু অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী একজন আইনজীবী জানিয়েছিলেন, তারা কীভাবে কলম্বোর সমুদ্র সৈকতে শিশুদের অপরাধে ব্যবহার করছে, এমন একটি দলকে চিহ্নিত করে আইনের মুখোমুখি করেন৷ আর তারপর কীভাবে তাঁরা শিশুদের ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বাভাবিক জীবনে৷
কিন্তু বাংলাদেশে শিশুদের অপরাধী বানিয়ে যেন কেউ কেউ হিরো হতে চান৷ পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর আর রাজনীতির কথা তো আগেই বলেছি৷ এবার জানুন কিছু সাংবাদিকের কথা৷
আইনে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের নাম, পরিচয় ছবি প্রকাশে বাধা আছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এ সব শিশু আটক হওয়ার পর তাদের ছবিসহ নাম পরিচয় প্রকাশ করে দেয়৷ কথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে প্রকাশ করে তাদের ‘অপরাধের আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য'৷ আবার কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল শিশু-কিশোর অপরাধের প্রতিবেদন দেখাতে গিয়ে শিশুকে দিয়েই অপরাধ করিয়ে তা প্রচার করে৷ এই শিশুদের ভবিষ্যত্ নিয়ে তাঁরা ভাবেন না৷ বুঝতে পারেন না যে, এ ধরণের প্রতিবেদন শিশুদের শেষ করে দেবে৷ তাদের আর সমাজ গ্রহণ করবে না৷ তাদের আরো ‘বড় অপরাধী' হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না৷ ঠিক যেমন পুলিশ শিশুদের জেলে পাঠিয়ে আরো ‘বড় অপরাধী' বানানোর রাস্তা খুলে দেয়৷