শেখ হাসিনার আহ্বান বনাম ভারতের জঙ্গি দমন
২ নভেম্বর ২০১৪এদিকে ভারত বলেছে তারা সেখানে থাকা বাংলাদেশবিরোধী জঙ্গিদের তথ্য সরবরাহ করবে৷ এই দুয়ে মিলে জঙ্গি দমনের রূপটি কেমন হবে?
গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে খগড়াগড়ে একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে দুই জন নিহত হন৷ তারা হলেন শাকিল আহমেদ এবং সোবহান মণ্ডল৷ ভারতীয় গোয়েন্দরা তখনই দাবি করেন নিহত দুইজন বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি'র সদস্য এবং তারা বাংলাদেশের নাগরিক৷ এরপর এই ঘটনায় জড়িত আরো ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
এরপর ভারতীয় তদন্ত সংস্থা এবং গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা তথ্য৷ যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো ভারতের মাটিতে বসে জেএমবি'র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ওপর হামলার পরিকল্পনা৷ শুধু তাই নয়, তারা আরো রাজনৈতিক নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলারও ছক তৈরি করে বলে ভারত এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে৷ এই হামলা পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে তার সুবিধা নেয়া৷
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার ভারতের একটি পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘ভারতবিরোধী জঙ্গিদের বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করেছে তাঁর সরকার৷ এবার ভারতের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পালা৷''
তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াটা যে কী মারাত্মক, সবাইকে তা উপলব্ধি করতে হবে৷ যখন খবর পাই পশ্চিমবঙ্গেই আশ্রয় নিয়ে জঙ্গিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, খুব খারাপ লাগে৷''
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন তাদের হাতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করা অন্তত ১৮০ জন জঙ্গির তালিকা রয়েছে, যা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে তুলে দেবেন৷ তাই স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গই বাংলাদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷
বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত ১২ পলাতককে ধরিয়ে দেয়ার জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করেছে ভারতীয় জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ৷ এনআইএ তাদের ওয়েবসাইটে ওই ১২ পলাতকের তালিকাও প্রকাশ করেছে৷ পলাতকদের পাঁচজনের জন্য ১০ লাখ রূপি অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে৷ ওয়েবসাইটে ‘বর্ধমান দলের হোতা' হিসেবে সাজিদকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ আর অপর চারজনকে ‘সন্দেহভাজন বাংলাদেশি নাগরিক' বলে বর্ণনা করা হয়েছে৷
এনআইএ দাবি করেছে, এই পাঁচজন প্রায়ই মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এবং বর্ধমান জেলায় অবস্থান করে৷ এই দলের শাহানুর আলম, হাবিবুর রহমান শেখ ও আমজাদ আলী শেখের জন্য আরো পাঁচলাখ রূপি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে৷ এছাড়া বর্ধমানের ম্যাঙ্গালকোটের বাসিন্দা আবুল কালাম ও বুরহাম শেখ এবং নদিয়ার জহিরুল শেখ ও বর্ধমানের রেজাউল করিমের জন্য আরো তিনলাখ রুপি অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি৷
এদিকে গত সপ্তাহে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দেভাল পশ্চিমবঙ্গ সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বর্ধমান বোমা বিষ্ফোরণের পিছনে একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী জড়িত৷ তাদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দারা কাজ করছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এখন চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে৷ দুই দেশই এখন পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কাজ করছে৷''
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন, ‘‘ভারতে অবস্থান করে জঙ্গিদের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার খবর আমরা জেনেছি অনানুষ্ঠানিকভাবে৷ আশা করছি আমরা আনুষ্ঠানিক তথ্য পাব৷''
বাংলাদেশের গোয়েন্দারা বলছেন ভারতে বাংলাদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় নেয়ার খবর তাদের কাছে আগেই ছিল৷ বাংলাদেশে ধারাবাহিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে তারা এখানে কোণঠাসা হয়ে পড়ার কারণে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে৷ বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১২ জন ভারতীয় জঙ্গিও ধরা পড়েছে৷ শুক্রবারও র্যাব জেএমবির প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুন নূরসহ পাঁচজনকে আটক করেছে৷ তারাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছে৷
জামায়াতুল মুজাহিদিন একটি আঞলিক জঙ্গি সংগঠন৷ এর বাংলাদেশ অংশের নাম জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি৷ ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট তারা বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায়৷ এরপর তারা আদালত এলাকায় হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যাসহ মোট ২৫ জনকে হত্যা করে৷ কিন্তু শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি এবং ব্যাপক অভিযানের মুখে তারা কৌশল পরিবর্তন করে৷ এর মধ্যে একটি ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা বলে জানান গোয়েন্দারা৷
ভারত বাংলাদেশকে সেখানে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গি এবং তাদের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেবে বলে জানা গেছে৷ তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই তথ্য দেয়াই যথেষ্ট নয়৷ ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি ও অবস্থান পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন৷ কারণ ভারতের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতায় অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছে৷ আর ভারতীয় জঙ্গিদেরও সহায়তা পাচ্ছে তারা৷ বাংলাদেশের জঙ্গিরা ভারতীয় জঙ্গিদের আশ্রয়েই সেখানে আছে৷ বর্ধমান বিস্ফোরণের মাধ্যমে তা প্রকাশ হলেও প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিনের৷ জঙ্গিরা এখন নতুন ছকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে কজ করে৷ তাই তাদের দমনে প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ধারাবাহিক তথ্য বিনিময়৷ সীমান্তে গরু ব্যবসায়ীকে হত্যার খবর শোনা গেলেও বিএসএফ কোনো জঙ্গিকে আটক করেছে এমন খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷
ভারতে যে ৩৬টি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের তালিকা এনআইএ তৈরি করেছে, তার ২৭ নম্বরে রয়েছে জেএমবি'র মূল সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন৷ আর বাংলাদেশে ৫টি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে এক নম্বর হলো জেএমবি৷
তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতের সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশবিরোধী জঙ্গিদের দমন করে সদিচ্ছার প্রমাণ রাখার এখনই সময়৷ প্রয়োজন মূল পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা৷