চাওয়া-পাওয়ার যোগ-বিয়োগ
১০ এপ্রিল ২০১৭বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘হাই-ভোল্টেজ' দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পরও তিস্তা চুক্তির বরফ গলেনি৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও৷ গত প্রায় ২০ বছর ধরে এই চুক্তি ঝুলে আছে৷ অনেকেই তাকিয়ে ছিল সেই দিকে৷ কিন্তু না, এ যাত্রাতেও তা অধরা রয়ে গেল৷ তবে সব মিলিয়ে শীর্ষ বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয় যে, শেখ হাসিনার চলতি সফরে তিস্তা চুক্তি সই না হলেও অচিরেই তা হবে এবং সেটা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে৷ এমনিতে সংবিধানের সংস্থান অনুসারে মোদী সরকার একাই যে কোনো দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে পারেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে৷ কিন্তু মোদী সরকার সে পথে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় পথেই যাবার পক্ষপাতি৷ তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গের চাষাবাদ বিশেষ করে খরা মরশুমে দারুণভাবে মার খাবে, এই অবস্থানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনড় থাকেন৷ নদীর উজানে একাধিক বাঁধ তৈরি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা আরও বেড়ে গেছে৷ প্রকাশিত বিবৃতিতে মোদী বলেন, বাংলাদেশের প্রতি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গভীর ভালোবাসা আছে৷ কাজেই খুব শীঘ্রই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে৷ একই মত ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা৷ তাঁর ইঙ্গিত সেটা যেন ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে হয়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে মোদীর ইঙ্গিত তিস্তা চু্ক্তি ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷
শনিবার প্রধানমন্ত্রীর মধ্যাহ্নভোজে রাতে রাষ্ট্রপতির নৈশভোজে মমতা-হাসিনা একান্ত বৈঠক হয়৷ তাতে মমতা নাকি এক বিকল্প সমাধান সূত্রের কথা বলেছেন৷ সেটা কী? শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের জলের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে, তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি নদী যেমন, তোর্সা, ফেনি, মহুরি, গুমতি, ধরলা বাংলাদেশে গিয়ে পড়ে৷ এ সব নদীর জল বিশেষ করে তোর্সার জল যাতে বাংলাদেশ ঠিকমত পায় সেটা সুনিশ্চিত করা যেতে পারে৷ বাংলাদেশের জল পাওয়া নিয়ে কথা৷
তিস্তার জল না গড়ালেও অন্য সব ক্ষেত্রে এই সফর পুরোপুরি সফল বলা যেতে পারে৷ মোট ২২টি চুক্তি সই হয়৷ ভারত উদার শর্তে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার উন্নয়নী সাহায্য দেবে যা ব্যয় করা হবে বাংলাদেশের অবকাঠামো ক্ষেত্রে৷ এর মধ্যে আছে রেল, সড়ক ও বন্দরসহ ১৭টি নতুন প্রকল্প৷ সই হয় ভারত-বাংলাদেশ বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি৷ সই হয় দুটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতাপত্র৷ ভারত থেকে সামরিক উপকরণ কিনতে দেওয়া হবে ৫০ কোটি ডলার ঋণ সাহায্য. দিল্লি-ঢাকার মধ্যে এই ধরনের সমঝোতা চুক্তি এই প্রথম৷ কাজেই এর একটা বাড়তি ভূকৌশলগত তাত্পর্য আছে৷
এই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি ডয়চে ভেলেকে বললেন, হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের সর্বস্তরে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই জরুরি৷ কারণ বিগত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি ভারত বিরোধী যেসব জঙ্গি সংগঠনগুলি বাংলাদেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়েছিল, হাসিনা সরকার ধীরে ধীরে তা সরিয়ে দিয়েছে. উলফা জঙ্গি নেতা পরেশ বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করেছে৷ হুজি, জামাতদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছন৷ এছাড়া অন্যন্য দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে বারংবার দিল্লিকে বার্তা দিয়েছে৷ ভারতের উচিত হাত বাড়িয়ে দেওয়া৷ শাহবাগের ঘটনার পর ভারত মনে করছে এটার পুনরাবৃ্তি হতে দেয়া যায় না৷
দিল্লি-ঢাকা প্রতিরক্ষা চুক্তির পেছনে ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত৷ দিল্লি ও ঢাকার উচিত একে অপরকে নিজের আস্থার বৃত্তে ধরে রাখা৷ প্রতিরক্ষা সমঝোতা প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক লাহিড়ি মনে করেন, এ বিষয়ে চীনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না৷ বেজিং ক্রমশই ঢাকার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তবে বাংলাদেশকে দু'টো সাবমেরিমসহ সমরাস্র সরবরাহ এমন মারাত্বক কিছু নয়৷
ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ ভারত পরিবেষ্টিত৷ বঙ্গোপসাগরের তিন দিকেই ভারত৷ বঙ্গোপসাগর ছাপিয়ে কিছু করা বেশ মুশকিল৷ মোটকথা, চীন ও পাকিস্তানকে চাপে রাখতে বাংলাদেশকেই পাশে রাখতে হবে৷ নিরাপত্তা হোক বা জঙ্গি দমন হোক বাংলাদেশকে হাতছাড়া করা কোনোমতেই ভারতের উচিত হবে না৷
নিজেদের এপার বাংলা ওপার বাংলার নৈকট্য বাড়াতে কোলকাতা-ঢাকার মধ্যে চালু করা হয় অতিরিক্ত ট্রেন ও বাস সার্ভিস৷ টেলি লিংকের মাধ্যমে দিল্লি থেকেই এই সার্ভিসের যাত্রারম্ভের সংকেত দেন মোদী ও হাসিনা৷ তাতে অংশ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও৷ দ্বিতীয় মৈত্রি এক্সপ্রেস যাতায়াত করবে শিয়ালদা খুলনার মধ্যে এবং বাস যাতায়াত করবে কলকাতা খুলনার মধ্যে৷ পরবর্তী কালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বসত বাড়ি টুঙ্গিপাড়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত৷ উত্তরবঙ্গের পরিত্যক্ত রাধিকাপুর রেল লাইন মেরামত করে বাংলাদেশের বিরোলি-পার্বতিপুর পর্যন্ত মালবাহী ট্রেন চলবে৷ এটা হবে দু'দেশের মধ্যে একটা হাইড্রো-কার্বন রুট৷ মোদী-হাসিনার যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রকাশ করা হয় শেখ মুজিবের লেখা একটি বইয়ের হিন্দি অনুবাদ৷ সেই লক্ষ্যে হাসিনার সফরের শুরু থেকেই একটা অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের এবং সৌহার্দের আবহ গড়ে তোলা হয়৷ এমনকি সব প্রোটোকল ডিঙিয়ে মোদী স্বয়ং দিল্লি বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে৷ এর আগে রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রাঙ্গনে শেখ হাসিনকে জানানো হয় প্রথাগত আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা৷ রাজঘাটে তিনি মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করেন, সাক্ষাৎ করেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আন্সারি ও সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে৷ রবিবার তিনি যান আজমির শরিফ দরগা দর্শনে৷ ফিরে এসে যোগ দেন দিল্লিতে শিল্প ও বণিক সংঘের বৈঠকে৷ আলোচনা হয় বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে৷