শ্রমিকের জীবনের দাম মাত্র দুই লাখ টাকা!
১০ জুলাই ২০২১বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি জানান, শ্রম আইনে যে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান আছে তার মধ্যে দুই লাখ টাকা ইন্সুরেন্স কোম্পানি, দুই লাখ টাকা সরকার এবং এক লাখ টাকা মালিকের দেয়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে সরকারের দুই লাখ টাকা ছাড়া মালিক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির টাকা শ্রমিকরা পান না৷ বাধ্যতামূলক হলেও অনেক কারখানা ইন্সুরেন্স করে না৷
তবে বাংলাদেশে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় আগুনসহ যেসব ঘটনায় শ্রমিকরা মারা যান তাকে ‘দুর্ঘটনা’ বলতে চান না বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস)-এর পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ৷
তার মতে এসব ঘটনার অধিকাংশই ‘হত্যাকাণ্ড, ফৌজদারি অপরাধ’৷ কারণ, শ্রমিকরা যে পরিবেশে কাজ করেন এবং আগুন বা অন্য কোনো ঘটনায় যেভাবে মূল ফটকে তালা মারা থাকে তা শ্রম আইন বিরোধী৷ সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের আসলে হত্যা করা হয়৷ এই অবহেলাজনিত হত্যার ঘটনা প্রমাণ করতে পারলে ক্ষতিপূরণের পরিমান আরো বেশি৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত এইসব ঘটনায় কোনো মালিককে শাস্তি পেতে দেখা যায়নি৷
রূপগঞ্জের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ওই প্রতিষ্ঠানে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে৷ ভবনটি তালাবদ্ধ ছিল৷ আগুন লাগার পরও তালা খোলা হয়নি৷ তারা ভবনে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও খুঁজে পাননি৷ ছিলো না আগুনের জন্য বিকল্প সিঁড়ি৷ তাই এই ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে অবহেলাজনিত হত্যা মামলা দায়ের করেছে৷ মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়াম্যানসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন৷ তাদের চার দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে৷
অবহেলাজনিত হত্যার জন্য দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৭ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর৷ যেখানে ৩০২ ধারায় হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
এদিকে রূপগঞ্জের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের জন্য দুই লাখ এবং আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলেছে শ্রম মন্ত্রণালয়৷ মালিক পক্ষ কোনো অর্থ সাহায়তা এখনও দেয়নি৷
অতীত উদাহরণ
বাংলাদেশে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনে ১১২ জন গার্মেন্টস শ্রমিক মারা যান৷ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে মারা যান এক হাজার একশ ৭৫ জন শ্রমিক৷ তারপর আরো অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ আর সর্বশেষ রূপগঞ্জে মারা গেলেন ৫২ জন৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের হিসাবে, এর বাইরে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরো প্রায় ৫০০ শ্রমিক পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন৷
বাংলাদেশের শ্রম আইনে যেসব কারখানায় কমপক্ষে ১০০ শ্রমিক আছেন সেখানে গ্রুপ বীমা থাকা বাধ্যতামূলক৷ তবে সব শ্রমিক এই বীমারা আওতায় আসে না৷ একজন শ্রমিক এখান থেকে সার্বোচ্চ দুই লাখ টাকা সুবিধা পান৷ কিন্তু ২০১৫ সালের পর অধিকাংশ শিল্পকারখানাই আর এই গ্রুপ বীমা করেনি বলে বীমা ও ব্যাংক খাত সূত্র থেকে জানা যায়৷
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, দুর্ঘটনার জন্য শ্রম আইনে যে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে তাও শ্রমিক বা তার পরিবার পান না৷ আর অবহেলাজনিত হত্যা প্রমাণ না হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না৷ এখন পর্যন্ত এই আইনে কোনো মালিক বা দায়ীরা শাস্তি পেয়েছেন এমর নজির নেই৷ তবে নানা দুর্ঘটনায় উচ্চ আদালত ক্ষতিপূরণের বেশ কিছু আদেশ দিয়েছেন৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘এখন সরকারের পক্ষ থেকে যে ক্ষতিপুরণ আছে তা আগে আরো কম ছিল৷ রানা প্লাজা ধসের পর তা বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়৷ কিন্তু এটাও অনেক কম ৷ এটা আরো বাড়ানো উচিত৷ আর মালিকপক্ষ নানা আইনের মারপ্যাচে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে৷’’