সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম-ক্রসফায়ারে আর ভয়ের চাদরে ২০২১
৩১ ডিসেম্বর ২০২১মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পরিস্থিতির তো কোন উন্নতি হয়নি, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে সহ্যসীমা সেটা অতিক্রম করার পর্যায়ে রয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম, ক্রসফায়ারে এখন ভয়ের চাদরে আবৃত হয়ে গেছে মানবাধিকার।
২০২১ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের পর্যবেক্ষন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে শুক্রবার। তাদের পর্যবেক্ষণ হলো, "বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, ধর্ষণসহ সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে, যা ভীতিকর। সারাদেশ আজ ভয়ের চাদরে আবৃত। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নানা কারণে বছরজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক, নারী-অধিকারকর্মী, বিরোধী দল, সমালোচক ও আইনজীবীদের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূলে ছিল।” বিশেষ করে গুমের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ক্রসফায়ার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ অনেক বেড়েছে। ক্রসফায়ারের সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় কমেনি।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মানবাধিকারের যে সূচকগুলো আছে সেগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবেন বাংলাদেশের কতজন মানুষ মনে করছেন তারা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন? বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন বা স্বাধীনভাবে প্রতিদিনকার জীবন নির্বাহ করতে পারেন? এটা একটা সূচক। আরেকটা সূচক হল, মানুষের যদি কোন অধিকার লঙ্ঘিত হয় তাহলে তারা কী ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেন? কেউ কী মনে করেন, আমি এই সমাজের একজন নাগরিক আমার অধিকার লঙ্ঘিত হলে আমি ন্যায়বিচার পাব? এই প্রত্যাশা কতখানি বিরাজমান সমাজে? তৃতীয় সূচকটা হল, তারা কতখানি নির্ভয়ে বসবাস করতে পারছে? আমি যে ধর্মের হই না কেন, পরিচয় যাই হোক না কেন এই দেশটা এমন একটা দেশ যেখানে আমি নির্ভয়ে বাস করতে পারি? সবকিছু বাদ দিয়ে যদি এই তিনটা সূচক নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রশাসন বা সরকারের জবাবদিহির অভাব রয়েছে। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি বা নারী নির্যাতন হোক আর সংখ্যালঘু নির্যাতন হোক কোথাও কোন বিচার হচ্ছে না। পূজার সময় হিন্দুদের উপর যে নির্যাতনটা হয়ে গেল সেটার কোন বিচার হয় না। রাষ্ট্রের মানবাধিকার রক্ষা করার যে দায়িত্ব সেটা সুচারুভাবে পালিত হচ্ছে না। এটা প্রতিনিয়ত নিম্নমুখী। কোথাও এটার উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন। এছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা গুলিবিনিময়ে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ৮ জন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পর শারীরিক নির্যাতনে ৬ জন, গ্রেফতারের আগে ১ জন ও হার্ট অ্যাটাকে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কারাগারগুলোতে এ বছর অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৮১ জন। এর মধ্যে কয়েদী ২৯ জন এবং হাজতি ছিলেন ৫২ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এটা বলার সুযোগ নেই। বরং মানুষের যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহ্যক্ষমতা আছে, যে পর্যন্ত হয়ত মানুষ সহ্য করতে পারে সেই পর্যায় অতিক্রম করতে যাচ্ছে। শুধু সংখ্যা দেখে তো লাভ নেই। কিছু কিছু ঘটনা নীতি-নির্ধারকেরা এমনভাবে উপস্থাপন করতে চান যে, এই ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। বরং ঘটনার কথা যারা বলছে, তারা প্রকারন্তরে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। এমন ধারণা যখন নীতি-নির্ধারকেরা সমাজে দিতে থাকেন তখন স্বাভাবিক কারণেই মানবাধিকার পরিস্থিতির শুভ কোন বার্তা আমরা দেখি না। পরিস্থিতির আরও অবনতি ও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে বলে আমরা মনে করি।”
বিদায়ী বছরে মানবাধিকার নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে হয়েছে সরকারকে। বছরের শেষে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাবের বর্তমান ও সাবেক প্রধানসহ সাত জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে এলিট ফোর্স র্যাবকে। যদিও সরকারের একাধিক মন্ত্রী এই নিষেধাজ্ঞার তীব্র সমালোনা করেছেন। কিন্তু বছর শেষ হলেও সেই নিষেধাজ্ঞা এখনও প্রত্যাহার হয়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন সাত জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ছয় জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন একজন। নিখোঁজ ইমাম মাহাদী হাসান ডলারের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। তার স্ত্রী গণমাধ্যম ও আসককে জানিয়েছেন, গত ৬ নভেম্বর বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় দুইটি মোটরসাইকেল ও সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে একদল লোক তাকে জোরপূর্বক তুলে নেয়।
সংগঠনটি বলছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ছিল ২০২১ সাল। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন (১৩ অক্টোবর) কুমিল্লার নানুয়ার দীঘি পূজামন্ডপে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ও তার পরপর চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মারধরের ঘটনা ঘটে। বিদায়ী বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০৪টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮৪টি বাড়িঘর ও ৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৩০০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
ভিন্নমত দমন করার লক্ষ্যে হয়রানিমূলক মামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনাও থেমে ছিল না বছরজুড়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল কমপক্ষে এক হাজার ১৩৪টি। এর মধ্যে বিভিন্ন থানায় ৮৮৩টি এবং সরাসরি আদালতে ২৫১টি মামলা হয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে থেমে ছিল না ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, সালিশ ও ফতোয়াসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা। ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয় জন। ২০২১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিদায়ী বছরটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো ছিল এটা বলা যাবে না। এটা শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই পরিস্থিতির খারাপ ছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। আমাদের সরকার যে চেষ্টা করছে না তা নয়। আসলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোন একটা সংস্থা নয়, সবগুলো সংস্থাকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সরকার নিশ্চয় সে চেষ্টা করবে।”