কণ্ঠরোধের হাতিয়ার বিজ্ঞাপন
১২ অক্টোবর ২০১৫এ নিয়ে ‘বাংলা ট্রিবিউন'-এ গত ২৯শে আগস্ট বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের সহযোগী বার্তা প্রধান প্রভাষ আমিন একটি কলাম লেখেন৷ তার শিরোনাম হলো, ‘প্রথম আলোর কণ্ঠরোধের চেষ্টা করবেন না'৷
তিনি তাঁর কলামের একাংশে বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন যেন একটু কম কম লাগছে৷ আমার কাছে ভালোই লাগছিল৷ পয়সা দিয়ে প্রথম আলো কিনি৷ বিজ্ঞাপন যত কম হয়, আমার ততই লাভ৷ খটকাটা হলো, বিজ্ঞাপন কমে গেল কেন? প্রথম আলোর কি সার্কুলেশন কমে গেছে, নাকি বিজ্ঞাপনদাতাদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে? প্রথম আলোকে কেন নিজেদের বিজ্ঞাপন দিয়ে পাতা ভরতে হচ্ছে? খোঁজ নিয়েও এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পেলাম না৷''
শুধু প্রথম আলো নয়, একই গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার'-এও বিজ্ঞাপন কমে গেছে৷ প্রভাষ আমিন রবিবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি একজন পাঠক হিসেবে লক্ষ্য করছি যে, প্রথম আলোতে এখন আর বেসরকারি টেলিফোন কোম্পানি এবং মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখা যায় না৷ কয়েকমাস আগেও এই চিত্র ছিল না৷ তবে এর নেপথ্যে কী বা কী কারণে এমন হলো – তা আমি অনুসন্ধান করে দেখিনি৷''
‘আদিবাসী' নিয়ে রিপোর্ট, প্রতিক্রিয়া
গত ১৬ই আগস্ট ‘রাঙামাটির বাঘাইছড়ি: সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে পাঁচ আদিবাসী নিহত' – এই শিরোনামে প্রথম আলো তাদের প্রথম পাতায় প্রধান খবর হিসেবে একটি সংবাদ পরিবেশন করে৷ এর পরদিন ১৭ই আগস্ট প্রথম আলো ওই খবর নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়৷ সেই ব্যাখ্যাটি ছিল এরকম – ‘‘গতকাল রোববার প্রথম আলোতে প্রকাশিত রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে পাঁচ সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার খবরের শিরোনাম নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে৷ নিহত পাঁচ ব্যক্তি যে সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য, তা প্রতিবেদনে একাধিকবার এবং হাইলাইটসে বা বড় হরফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে৷''
প্রথম আলো তাদের ব্যাখ্যায় আরো লেখে – ‘‘শিরোনামে এবং প্রতিবেদনের শুরুতে ‘আদিবাসী' লেখার অর্থ এই নয় যে, তারা নিরীহ যুবক৷ আমরা গতকালও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, নিহতরা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য৷ উল্লেখ্য, সংবিধানে পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে৷''
পর্যবেক্ষকদের মতে, ১৬ই আগস্টের পর থেকেই প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বিজ্ঞাপনে ধস নামে৷ বিজ্ঞাপনী এজেন্সি হিসেবে কাজ করে এ রকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে ডয়চে ভেলে৷ তাদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের মাধ্যমে প্রথম আলোর শতকরা ৮০ ভাগ বিজ্ঞাপন আসে৷ সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘‘প্রথম আলোতে এ মুহূর্তে প্রধানত বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ আছে৷ আমরা কিছু বুকিংও বাতিল করেছি৷''
কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিজ্ঞাপন বন্ধ
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গ্রামীণ ফোনসহ পাঁচটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর সংবাদমাধ্যমগুলিতে প্রধান বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে বিবেচিত৷
এই গ্রামীণ ফোনের অধিকাংশ শেয়ার নরওয়ের ‘টেলিনর' গ্রুপের৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিনর-এর এশিয়া অঞ্চলের প্রধান টর ওডল্যান্ড ই-মেল মারফত জানান, ‘‘বাংলাদেশের দু'টি প্রধান দৈনিকে (পত্রিকা) বিজ্ঞাপন না দেয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ এর ফলে গ্রামীণ ফোন গ্রাহকদের সঙ্গে পত্রিকার মাধ্যমে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটি ব্যর্থ হচ্ছে৷ এরইমধ্যে টেলিনর এবং গ্রামীণ ফোন বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, এই প্রতিক্রিয়া কমিয়ে আনতে৷ তার মধ্যে অন্যতম হলো কর্তৃপক্ষ, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী ও মিডিয়া পার্টনারদের সঙ্গে মতবিনিময়৷ আমরা আশা করছি, এর মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রে শিগগিরই বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবো৷''
টর ওডল্যান্ড-এর বক্তব্যে অবশ্য এ কথা স্পষ্ট নয় যে, কোন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা বাংলাদেশের প্রধান দু'টি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ রেখেছে৷
এদিকে বাংলাদেশে পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের প্রবাহ পর্যক্ষেণ ও তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রধান হলো রায়ান্স আর্কাইভস লিমিটেড৷ তাদের কাছ থেকে ডয়চে ভেলে আগস্টের প্রথম পাঁচদিন এবং সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে পরবর্তী পাঁচদিনের বিজ্ঞাপন প্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করে৷ তাতে দেখা যায়, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার ১৬ই আগস্টের আগে গ্রামীণ ফোন, রবি, এয়ারটেলসহ বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং ইউনিলিভারসহ বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রধানভাবে পেত৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন বলতে গেলে নেই৷
হিসাব বলছে বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে গেছে
রায়ান্স আর্কাইভস লিমিটেড-এর আরেক হিসাব থেকে দেখা যায়, জুলাই মাসে প্রথম আলো একদিনে গ্রামীণ ফোন, রবি, বাংলা লিংক, এয়ারটেল, টেলিটক, প্যাসিফিক টেলিকম এবং ইউনিলিভার থেকে বিজ্ঞাপন পেয়েছে ৬ কোটি ৩২ লাখ ৩০হাজার ৭০০ টাকার৷ অথচ সেপ্টেম্বর মাসে পেয়েছে মাত্র ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন৷ এই তারিখে এয়ারটেল, টেলিটক ও প্যাসিফিক টেলিকম কোনো বিজ্ঞাপন দেয়নি৷
ওদিকে ডেইলি স্টারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জুলাই মাসে ছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ১০০ টাকার বিজ্ঞাপন৷ আর সেপ্টেম্বর মাসে এক্ষেত্রে তারা পেয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন৷
রায়ান্স আর্কাইভস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ হাসান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণে এটা স্পষ্ট যে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং কিছু বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন কমে গেছে৷ আর সেটা দৃশ্যমানভাবেই কমেছে৷ প্রথম আলো অন্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও, ডেইলি স্টারের পুষিয়ে নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে এই দুটি পত্রিকার এই অবস্থা অতীতে আমাদের পর্যবেক্ষণে কখনো দেখা যায়নি৷'' এছাড়াও একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, সম্প্রতি প্রথম আলোর মোট বিজ্ঞাপন বাবদ আয় ২৫ ভাগ আর ডেইলি স্টারের ২৫ ভাগ কমে গেছে৷
এ নিয়ে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে যোগাযোগর চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি৷
রায়ান্স আর্কাইভস লিমিটেড-এর তথ্য মতে, জুলাই মাসে প্রথম আলো মোট বিজ্ঞাপন পায় ২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার৷ এর মধ্যে টেলিকম খাত ও ইউনিলিভার থেকে তারা পেয়েছিল শতকরা ২৫ ভাগ বিজ্ঞাপন৷
সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আলো মোট বিজ্ঞাপন পায় ১৫ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৯০০ টাকার৷ এর মধ্যে ফোন কোম্পানি এবং ইউনিলিভার-এর বিজ্ঞাপন মাত্র শতকরা ১ ভাগ৷ অর্থাৎ জুলাই মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আলো ৯ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন কম পেয়েছে৷
প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দু’টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে চাপ সৃষ্টির ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখছেন? আপনার মতামত জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে৷