সংস্কার হবে ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিং
১২ আগস্ট ২০১৩এমন উদ্যোগ এর আগে কোনও সরকার নেয়নি৷ ফলে ইতস্তত বিরুদ্ধতা যেমন আছে, তেমন অনেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই সিদ্ধান্তকে একবাক্যে মেনে নিতে পারছেন না৷ অনেকে আবার সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, আদৌ এই সংস্কার যথাযথ নিয়ম মেনে হবে কিনা৷ অনেকে উপযাচক হয়ে উপদেশ দিচ্ছেন, সংস্কারের দায়-দায়িত্ব কাদের হাতে থাকা উচিত এবং কীভাবে কাজটা করা উচিত৷ আবার অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এটা বোঝাতে যে, মুখ্যমন্ত্রীর এই তুঘলকি সিদ্ধান্তে প্রশাসন চালাতে কতটা অসুবিধে হবে৷
কিন্তু প্রকাশ্যে অথবা গোপনে সবাইকে একটা কথা স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মতো কলকাতার এক ঐতিহ্যশালী ইমারত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বাস্তুবিশারদ পণ্ডিতেরা এতদিন কেবল মুখেই বলেছেন, কিন্তু সক্রিয় উদ্যোগ নিতে কেউ এগোননি৷ কারণ সবাই জানতেন, নিয়মিত, দিনের প্রায় ১৮ ঘণ্টা ব্যবহার হওয়া একটা সরকারি ভবন সংস্কারের কাজ কতটা দুঃসাধ্য৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অসাধ্য সাধনই করতে চলেছেন৷ আগামী অক্টোবর মাস থেকে ফটক বন্ধ হয়ে যাবে মহাকরণ ভবনের৷ মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর-সহ সবকটি মন্ত্রক ও সচিবালয় পরবর্তী ছমাসের জন্য ঠিকানা বদলে চলে যাবে হুগলি নদীর ওই পাড়ে, হাওড়ার ডুমুরজলায় একটি বহুতল ভবনে৷
অনেকেই আপত্তি তুলেছেন, রাজ্যের প্রশাসনিক ভরকেন্দ্রটি কলকাতা থেকে হাওড়ায় চলে গেলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে৷ কিন্তু সেটা নেহাতই ছিদ্রান্বেষীদের ছেঁদো তর্ক৷ বরং প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ, নির্দিষ্ট একটি জায়গায় না রেখে বহু জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার দরকার ছিল অনেক আগেই৷ তা হলে কলকাতার ডালহৌসি এলাকায় নিত্যকার যানজট হতো না, বরং মধ্য কলকাতায় যাতায়াত অনেক কম কষ্টসাধ্য হতো এবং তাতেই দুর্ভোগ কম হতো মানুষের৷ যেমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সংস্কারের কাজ শেষ হয়ে গেলেও মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর হয়ত ওই বাড়িতে ফিরবে না৷ জেনারেল পোস্ট অফিস ভবনের উল্টোদিকে যে আধুনিক প্রশাসনিক ভবন তৈরি হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো সেখানেই বসবেন৷
তা-ই যদি হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত রাইটার্স বিল্ডিংকে তার হৃৎগৌরব ফিরিয়ে দিয়ে, ঐতিহ্যবাহী ইমারতটিকে প্রাত্যহিক ব্যবহারের ধকল থেকে রেহাই দিতে চাইছেন৷ সেটা যদি হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে আরও বেশি সাধুবাদ জানাতে হয়৷ কারণ যে কোনও হেরিটেজ স্থাপত্যকে রক্ষা করতে গেলেই তাকে একটু হাঁফ ছাড়ার, একটু নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ দিতে হয়, যেটা এত বছরে কারও মনোভাবে দেখা যায়নি৷ কাজেই যাঁরা এখন রাজ্য সরকারকে উপদেশ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা এটুকু আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পুনরুজ্জীবনই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে চলেছে৷
শুধু ভবনটির সংস্কারই নয়, শোনা গিয়েছে, বিশেষজ্ঞ বাস্তুকারদের সঙ্গে কথা বলে ওই বাড়ির স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যে চেহারা, সেটি ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় উইং আর দুপাশের দুটি উইংয়ের মাঝের উঠোনে যে ইমারত গড়ে তোলা হয়েছিল বাড়তি জায়গা পেতে, সেই চারটি ব্লক ভেঙে ফেলা হবে৷ এ ব্যাপারে সেই ১৮৭৭ সালে ব্রিটিশ স্থপতি ই জে মার্টিন-এর করা নকশাটিকেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হবে৷ ওই সময়ের পর, ১৮৮৯ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে দুটি নতুন ব্লক সংযোজিত হয়েছিল মূল ভবনের সঙ্গে৷ সেই দুটিও অটুট থাকবে৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্ষায় বেহাল রাস্তাঘাট সারানো বা আরও নানা উন্নয়নমূলক কাজে যখন সরকারি অর্থ খরচ করার দরকার ছিল, তখন কেন হেরিটেজ ইমারতের সংরক্ষণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ বলতেই হবে যে সেখানেও খুব দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সাম্প্রতিক অতীতে যতবার রাইটার্সে ছোটখাট শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, ততবার দমকল দপ্তর সতর্ক করেছে যে কার্যত জতুগৃহ হয়ে আছে মহাকরণ৷ যে কোনও দিন বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে৷ এছাড়া সিলিং থেকে চাঙড় খসে পড়ার মতো দুর্ঘটনাও ঘটেছে৷ যদি সত্যিই একদিন কোনও বড় বিপত্তি ঘটে যায়, তার জন্যে অবধারিতভাবে সরকারকেই দায়ী করা হবে৷
ফলে রাইটার্স ভবনের ইতিহাসে প্রথম তালা পড়বে ফটকে৷ ফাঁকা হবে সমস্ত ঘর৷ শুরু হবে সংস্কার৷ বাদ যাবে বাহুল্য৷ একদিন ফের তার রাজসিক গর্ব নিয়ে কলকাতা শহরের অন্যতম ঐতিহ্যচিহ্ন হয়ে উঠবে রাইটার্স বিল্ডিং, যার কৃতিত্বটা পুরোপুরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই প্রাপ্য হবে৷