সন্তানের অধিকার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার
২২ জুলাই ২০২২বার সম্পদের ওপর সন্তানের অধিকার জন্মায় তার মৃত্যুর পর৷ সেখানে অনুসরণ করা হয় ধর্মীয় আইন৷
সম্পত্তির অধিকার বাংলাদেশে ধর্মীয় আইন বা পার্সোনাল ল দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়৷ ফলে এর জন্য কোনো ‘ইউনিফর্ম' আইন নেই৷ ধর্মের যে বিধান আছে, সেই বিধানটিই সেই ধর্মাবলম্বীদের জন্য আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ ওই আইনগুলোর উৎস ধর্ম৷ বাংলাদেশে মুসলিম সন্তানরা বাবার মৃত্যুর পর তার সব ধরনের সম্পদের উত্তরাধিকারী হন৷ কিন্তু সেখানে ছেলে আর মেয়েতে পার্থক্য আছে৷ ছেলেরা যা পান, মেয়েরা পান তার অর্ধেক৷ হিন্দু ধর্মে মেয়েরা বাবার কোনো সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না৷ তবে খ্রিস্ট্রান ধর্মালম্বী ছেলে-মেয়ে বাবা-মায়ের সম্পত্তির সমান অংশীদার হন৷ বৌদ্ধ ধর্মে মেয়েরা পান না, তাদের বেলায় হিন্দু আইন অনুসরণ করা হয়৷ এর বাইরে যারা আদিবাসী আছেন, তারাও তাদের ধর্মের বিধান অনুসরণ করেন৷
সন্তানের প্রতি দায়িত্বের আইন নেই
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘‘বাবার মৃত্যুর পর সন্তানরা তাদের সম্পদের অধিকারী হলেও শিশু জন্মের পর থেকে তাদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন এসব ব্যাপারে কোনো আইন নেই৷ তবে অভিভাবকত্ব আইনে শিশু সন্তানের প্রতি অবহেলা ফৌজদারি অপরাধ৷ এখানে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হিসবে গণ্য করা হয়৷ যদি বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাহলে যার যার ধর্মের ভরণপোষণ আইনে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের গার্ডিয়ানশিপ নির্ধারণ করে আদালত খরচের পরিমাণ বেঁধে দেন৷”
অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল আরো বলেন, ‘‘কিন্তু সন্তানকে না দেখলে তাকে ভরনপোষণ না করলে, পড়াশুনা না করালে, সঠিক পরিবেশে না রাখলে অথবা ফেলে রেখে গেলে আইনে বাবা-মা-কে বাধ্য করার কোনো বিধান নেই৷ কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই৷ অবহেলার অভিযোগে জেলে পাঠিয়ে কী হবে যদি সন্তান খেতেই না পায়? তাই আমরা মনে করি, এজন্য আইনের দরকার আছে৷ পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন আছে৷ সন্তান পিতা-মাতাকে দেখতে বাধ্য৷ তাহলে সন্তানের জন্য আইন থাকে না কেন? তাই সন্তানদের জন্যও আলাদা আইন এখন সময়ের দাবি৷”
সম্পত্তির অধিকারে বৈষম্য
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে থাকেন বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার৷ কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ে কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ বাংলাদেশে এখনো নেয়া হয়নি৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘সম্পত্তির অধিকারের মুসলিম আইনটি পবিত্র কোরান থেকে এসেছে৷ পারিবারিক আইনের অনেক পরিবর্তন হলেও এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়নি৷ এর প্রবল বিরোধিতা আছে৷ মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অর্ধেক পাবেন৷ কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি ছেলে না থাকে, তাহলে বাবার মৃত্যুর পর তার সম্পদের বড় অংশ বাবার ভাইদের হাতে চলে যায়৷ মেয়েটি পায় সামান্যই৷”
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘‘তারপরও মুসলিম আইনে পিতা-মাতার সম্পত্তির যেটুকু অধিকার মেয়েদের দেয়া হয়েছে, সেটাও তারা পান না৷ তাদের দেয়া হয় না৷ ঠকানো হয়৷ এমনকি বাবাও মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ দিতে চান না৷”
আইনজীবী ফওজিয়া করিম মনে করেন, আইনের সংশোধনের আগে মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার, ‘‘কারণ, ওই আইনের মধ্যেই চাইলে ছেলে-মেয়েদের সমান সম্পত্তি দেয়া যায়৷ সেটা করা যায় দানের মাধ্যমে৷ তবে দান বাবার মৃত্যুর আগেই কার্যকর করতে হবে৷ নিবন্ধন করে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হবে৷'' তিনি বলেন, "আমরা পাঁচ ভাই-বোন৷ আমাদের বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায়ই আমাদের সব ভাই-বোনকে সমানভাবে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন৷ সুতারাং চাইলে দেয়ার সুযোগ এখনো আছে৷”
এতে কোনো ধর্মই বাধা হতে পারেনা৷ হিন্দু ছেলে-মেয়েকেও তার বাবা এভাবে দিতে পারেন বলে জানান তিনি৷ উইল যেটা মৃত্যুর পর কার্যকর হয়, সেটা মোট সম্পদের তিন ভাগের একভাগ করা যায়৷ তবে উইল ভাইয়েরা অনেক সময় মানতে চায় না৷
ভারতে হিন্দু আইন সংস্কার
হিন্দু আইনের উৎস তাদের নানা ধরনের প্রথা ও ঐতিহ্য, যার মধ্যে দায়ভাগ ও মিতক্ষরা অন্যতম৷ বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অংশে দায়ভাগ অনুসরণ করা হয়৷ বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে শুধু ছেলেরাই বাবার সম্পদ এবং সম্পত্তির অধিকার পান৷ মেয়েরা পান না৷ মেয়েদের বিয়ের সময় যা দেয়া হবে, তারপর আর কিছু পাবেন না৷ আইনজীবী তপন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ভারতে আইন সংশোধন হয়েছে৷ সেখানে হিন্দু ছেলে-মেয়ে তার বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পান৷ বাংলাদেশেও আইন সংশোধনের জন্য হাইকোর্টে রিট হয়েছে৷ শুনানির অপেক্ষায় আছে৷”
তিনি বলেন, "তবে কিছু আইন এরইমধ্যে পরিবর্তন হয়েছে৷ হিন্দু আইনে ছিল একটি মাত্র ছেলে রেখে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী শুধু শহরের সম্পত্তির অর্ধেক পেতো৷ গত বছর হাইকোর্ট রায় দিয়েছে স্ত্রী শহর-গ্রাম সব জায়গায়ই সম্পত্তির অর্ধেক, মানে ছেলের সমান পাবেন৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি সংবধিান অনুযায়ী চাই৷ সংবিধানে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার৷ তাই পিতা-মাতার সম্পত্তিতেও ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার চাই৷ কিন্তু এর বিরোধিতা করছেন অনেকে৷ তারা মনে করছেন, কোনো হিন্দু মেয়ে যদি অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করে তাহলে সম্পদ অন্য ধর্মে চলে যাবে৷ এই ভয় তাদের মধ্যে কাজ করে৷”
ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘হিন্দু মেয়েদের একটা জীবন স্বত্ব অধিকার আছে৷ সেটা বাবা বা স্বামী কাছে বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই অধিকার পান৷ কিন্তু সমস্যা হলো, সেই সম্পদ তারা শুধু জীবন ধারণের জন্য ব্যবহার করতে পারেন৷ সেটা তারা বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন না৷”
অন্য ধর্মের বিধান
ইশরাত হাসান জানান, ‘‘খ্রিস্টান ধর্মে যে উত্তরাধিকার আইন আছে তাতে ছেলে-মেয়ে পিতার সম্পত্তির সমান অংশীদার হন৷ বৌদ্ধরা এখানে হিন্দু আইন অনুসরণ করে৷ মেয়েরা সম্পত্তি পান না৷ আর আদিবাসীরা তাদের ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেন৷ কোথাও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, কোথাও মাতৃতান্ত্রিক৷ সেইভাবেই অধিকার নির্ধারণ করা হয়৷”
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের অধীনে বিয়ে হলে ওই দম্পতির ছেলে মেয়ে কোন নিয়মে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন? ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘বাবা যে ধর্মের সেই ধর্মের আইন অনুযায়ী হবে৷ তবে ওই দম্পতি যদি ঘোষণা করেন যে, তারা কোনো ধর্মের অনুসারী নন, তাহলে ছেলে-মেয়ে সমান পাবেন, অথবা তারা ইচ্ছা অনুযায়ী দান বা উইল করে যেতে পারেন৷''
ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ যদি যার যার ধর্ম অক্ষুন্ন রেখে, অথবা তারা কোনো ধর্মই বিশ্বাস না করলে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের অধীনে হয়৷
আইন সংস্কার কতটা সম্ভব?
মুসলিম আইনে যে বিধান আছে, সে অনুযায়ী ছেলে বা মেয়েসহ কোনো উত্তরাধিকারকেই সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার বিধান নেই৷ সন্তানকে ত্যাজ্য করার বিধান মুসলিম আইনে নেই৷ তবে হিন্দু আইনে এই বিধান আছে বলে জানান ইশরাত হাসান৷
তিনি বলেন, "হিন্দু আইন ভারত থেকে এসেছে৷ সেই ভারতেই আইন সংস্কার হয়ে ছেলে-মেয়েকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে৷ এখানে পরির্তনে বাধা কোথায়? আর মুসলিম আইনেরও তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ আর আমাদের এখানে তো ইসলামিক আইন চালু নেই৷ সেখানে উত্তরাধিকার আইনেও পরিবর্তন হওয়া দরকার৷”
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বার বার বাবা-মায়ের সম্পদে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকারের কথা বললেও আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ আমরা এখনো দেখছি না৷ উল্টো যারা এটা নিয়ে কথা বলছেন, তারা ধর্মীয় গোষ্ঠীর রোষের শিকার হচ্ছেন৷ তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে৷”
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ‘‘আইন পরিবর্তনের আগে মাইন্ডসেটের পরিবর্তন জরুরি৷ দেখা গেল আইন করা হলো, কিন্তু কেউ মানছেন না৷ এরকম অনেক আইন আছে৷”
তার কথা, "বাস্তবতাও বুঝতে হবে৷ কারণ, এর সাথে ধর্ম, রাজনীতি, আর্থ সামজিক অবস্থা অনেক কিছু জড়িত৷ বর্তমান বাস্তবতায় তাই আইনের পরিবর্তন আপাতত সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি৷ আগে প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে৷ সেই প্রেক্ষাপট হলে তখন হয়ত সংস্কার করা যাবে৷ অ্যামেরিকায় গান কন্ট্রোল আইন জরুরি এবং যৌক্তিক৷ তারপরও করা যাচ্ছে না৷ এই বাস্তবতা আমাদেরও বুঝতে হবে৷”
বিশ্লেষকরা ইউনিফর্ম ফ্যামিলি আইনের কথাও বলছেন৷ সেটা হলে সবার জন্য একই আইন হবে৷ উত্তরাধিকার আইনও সবার জন্য একই হবে৷ আর আলাদা একটি আইন করে যদি বাবা-মা যে ধর্মেরই হোক তাদের সম্পত্তির ব্যাপারে ডিক্লারেশনের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তারা সেই আইনের আওতায় ছেলে-মেয়েকে সমান ভাগ দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন৷