‘অভিন্ন পারিবারিক আইন হলেই কেবল সংকটের সমাধান হবে’
২২ জুলাই ২০২২এতদিনেও কেন এই আইনের সংস্কার হলো না? বাধা কোথায়? এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করি'র সমন্বয়ক ও অধিকার কর্মী খুশি কবীর।
ডয়চে ভেলে : সন্তানের অধিকার সম্পর্কে বাংলাদেশের আইনে কী আছে?
খুশি কবীর : বাংলাদেশে পারিবারিক আইন হচ্ছে, যে যে ধর্ম পালন করে বা যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছে সেই ধর্মের ভিত্তিতেই পারিবারিক আইনটা। পারিবারিক আইনে উত্তরাধিকার আছে, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকতা আছে। যেহেতু পারিবারিক আইনে উত্তরাধিকার আসে, সেখানে সন্তানের যে অধিকার, সেটা যে যে ধর্মের, তার ভিত্তিতে চলে। আমি যদি মুসলিম আইনের কথা বলি, সেখানে আইয়ুব খান কিছু সংশোধন করেছিল। ওটাই এখনও চলছে। সেখানে বাবা-মা মারা যাওয়ার আগে যদি সন্তান মারা যায়, তাহলে তার সন্তানরা দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতো। সেটা আইয়ুব খান সংশোধন করে বলেছে, বেঁচে থাকলে যদি সম্পত্তির উত্তরাধিকার নাতি-নাতনি হন, তাহলে তার বাবা আগে মারা গেলেও তারা সেই অধিকার পাবেন। আইনে যেভাবে ভাগ করা আছে, সেভাবেই পাবেন। এটা এখনও প্রযোজ্য আছে। তবে আইনের দুইটা জায়গা আমাদের কাছে খারাপ লাগে। সেটা হলো, এক. নারীরা বাবা মায়ের সম্পত্তি ভাইয়ের অর্ধেক পাবে। দ্বিতীয় হলো, যদি কোনো পুত্র সন্তান না থাকে, তাহলে কন্যা পাবে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক পাবে ভাইয়ের ছেলেরা।
এই আইনে মা-বাবা, না সন্তানদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে?
এখানে প্রাধান্য বলতে কী, মেয়ে হলে বাবার সম্পত্তির পুরোটা পাবে না। অনেকেরই তো শুধু মেয়ে আছে। মেয়েদের এখানে টোটালি বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই কারণে অনেক বাবা-মা আপসেট ফিল করে। তারা যে বলেন, তারা সম্পত্তিটা করেছে, উত্তরাধিকারের না, অবশ্য উত্তরাধিকারের হলেও বা কী, তাদের এই সম্পত্তির পুরোটা কন্যারা নিতে পারবে না। ভাইয়ের সন্তানরা এসে এটাতে ভাগ বসাবে।
এই আইন কি সংস্কার হওয়া প্রয়োজন?
অবশ্যই। আমি আরেকটু যোগ করি, স্বামী মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী আট ভাগের একভাগ, অর্থাৎ দুই আনা সম্পত্তি পাবে। কিন্তু একজনের স্ত্রী মারা গেলে তার সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ চার আনা তার স্বামী পাবে। এখানেও ভাগ অর্ধেক। অনেকে বলে যে, সে তো তার বাপের থেকে পায়, স্বামী থেকে পায়। কিন্তু স্বামীও স্ত্রীর থেকে দ্বিগুণ পায়। সন্তানও তার বাপের কাছ থেকে দ্বিগুণ পায়। পুরুষ আর নারী সন্তানদের মধ্যে এই পার্থক্যটা চলে আসছে। এটা অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত। আরেকটা পরিবর্তন আইয়ুব খানের সময় হয়েছে, সেটা একটা ভালো দিক আমি বলবো। বাবা-মা মারা গেলে, দাদা-দাদী বেঁচে থাকলে তার সন্তানরা যেন বঞ্চিত না হয়। কিন্তু তার বিধবা স্ত্রী বঞ্চিত হবে। তিনি কিছু পাবেন না। অবশ্যই এটার পরিবর্তন দরকার। হিন্দু আইন ভারতে প্রচুর পরিবর্তন করেছে। যেখানে সন্তানরা সম্পত্তির অংশ পায়, বিধবাও সম্পত্তি পায়। নারীরা ডিভোর্স দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এটার পরিবর্তন কোনোদিন আনতে দেওয়া হয়নি। এখানে বৌদ্ধদের নিজস্ব আইন না থাকায় তারা হিন্দু আইন অনুসরণ করে। মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ আইন পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে এখানে নারী কোনো সম্পত্তি পায় না। একজন বিধবা থাকার অধিকার পায় আজীবন। কিন্তু সে কখনো সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বিক্রি করতে পারে না। এটা তো বঞ্চিত করা। মুসলিম পরিবারেও বাবা মারা যাওয়ার পর মেয়ে যদি তার সম্পত্তিটা ভাগ করে নিতে চায়, সেখানেও কিন্তু তার ভাই, মা, আত্মীয়রা সেটা দিতে চায় না। যেসব পরিবার একটু প্রগতিশীল, তারা সেটা ভাগ করে দেয়। অনেক পরিবার আছে, তারা বলে, ভাগ করার দরকার নেই এটা থাকুক। এখানে আইন প্রয়োগ করা হয় না।
এতদিন এই আইনটার সংস্কার হয়নি কেন?
বহু বছর ধরে আমরা এই দাবিটা করেই আসছি। এটা পরিবর্তনের জন্য আমরা অনেক বলাবলি করেছি। এটা পরিবর্তনের কথা বললেই, সাথে সাথে হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, সব ধর্মের যারা পুরুষ যাজক আছে, তারা সাঙ্ঘাতিকভাবে আপত্তি তোলে, হৈ চৈ করে, অনেক উগ্রতা করে এবং সরকারকে বলে তারা এটা মানবে না। কোনোভাবেই এটাকে ধরতে দেওয়া হবে না। সরকার চাইলে এটা করতে পারে। জাতিসংঘে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যে সনদ আছে, তার সবগুলো ধারাই বাংলাদেশ সই করেছে। শুধু দুটি ধারা বাদে। এই দুটি ধারা হলো, উত্তরাধিকারের ব্যাপারে। এই জায়গাটাতে বাংলাদেশ সই করেনি। তার মানে, ধর্মীয় যাজকদের তারা এত ভয় পায়, যে কারণে এটা করতে চায় না। আমরা তো এটা নিয়ে সারাক্ষণই বলে যাচ্ছি। আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী নিজেও কিন্তু চান যে, এটার পরিবর্তন হোক। পুরো সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা আর অনেক পুরুষ কোনোভাবেই এটাকে পরিবর্তন করতে দেবে না। পরিবর্তনটা অবশ্যই দরকার।
আইনের পরিবর্তন হলে কি আবার একটি পক্ষ সমস্যায় পড়তে পারে ?
তার মানে, সে চাচ্ছে না সমান অধিকার। সে ভোগ বেশি করতে চাচ্ছে। আমরা তো কাউকে বঞ্চিত করতে বলছি না, আমরা বলছি, সবাইকে সমান চোখে দেখা। দুটোর পার্থক্য তো বুঝতে পারছেন? একটা হলো, আমি সব ভোগ করবো, আমার কাছে সব থাকবে। আরেকটা হলো, সবাই সমান পাবে। সবাই তো সন্তান, সন্তান হিসেবে সবার সমান অধিকার হবে।
এই আইনের সংশোধনে সমাজে কি মা-বাবা, সন্তান বা ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
আমার তো মনে হয় সম্পর্ক আরো ভালো হয়ে যাবে। কাউকে তো তখন বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে না। নাগরিক হিসেবে আমি বলবো, আমাদের সংবিধানে বলা আছে সকল নাগরিকের সমান অধিকার। এই আইন তো এটাকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুন্ন করছে।
এখন এই সংকট থেকে সমাধানের পথ কী?
সমাধানের পথ খুব সহজ। সরকার সাহস করে যদি এটা করে, কেউ কেউ হৈ চৈ করতে পারে, হৈ চৈ তো অনেক সময় অনেক কিছুতে করা হয়। তারপরও তো সরকার অনেক কিছু এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এসব বিষয়ে নারীরা কত ধরনের সমস্যা নিয়ে আপনাদের কাছে আসেন?
এটা তো প্রায়ই আসেন। শুধু নারী না, বাবা-মায়েরাও আসেন। তারা সমান দিতে চান তাদের মেয়েকে। অহরহ আসতে থাকে। মুসলিম আইনে হেবা করা বা উপহার দেওয়ার বিধান আছে। হেবা করতে গেলে আবার একটা সমস্যা থেকে যায়। হেবা করার পর কোনো কারণে সন্তানরা যদি বাবা-মাকে না দেখেন, তখন বাবা-মায়ের আর হক থাকে না। কারণ, সম্পত্তি সে আগেই দিয়ে দিয়েছে। এটা একটা সমস্যা হয়ে থাকে। আবার এমনও দেখেছি, সম্পত্তি হেবা করে দিয়ে দিয়েছে, পরে সন্তানরা আর বাবা-মাকে দেখাশোনা করেনি।
আইনের কারণে তাদের কী ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়?
আইনে যদি সন্তানরা সমান অধিকার পায়, তাহলে বাবা-মাকে তো আর হেবা করতে হবে না। বাবা-মা মারা গেলে সে তো সম্পত্তির সমান অধিকার পাবে। এটা খুবই সহজ, অনেক ইজি হয়ে যাবে।
মুসলিম ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের নারীরা কি এসব সমস্যা নিয়ে আপনাদের কাছে আসেন?
বেশি সমস্যা তো হিন্দু আর বৌদ্ধদের মধ্যে। হিন্দু নারীরা তো এটা নিয়ে বহু আন্দোলন করেছে। হিন্দু পুরুষরা এত খোঁড়া অজুহাত দেয় যে, তারা নারীদের সম্পত্তির অধিকার দিতে অনেক ভয় পায়। হিন্দু নারীরা সাংঘাতিকভাবে বঞ্চিত।
হিন্দু নারীদের এই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ কী?
আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি, একটা অভিন্ন পারিবারিক আইন দরকার, যেটার ভিত্তি হবে সবার সমান অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা।