সন্দেশখালির জেরে অশান্ত বসিরহাট, ১৪৪ ধারা
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে পৃথক পৃথক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ শাসক ও বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল তাদের বসিরহাট আদালতে পেশ করা হয়। এ নিয়ে ঘটনাক্রম ছিল নাটকীয়তায় মোড়া।
জামিনের পর গ্রেপ্তারি
সন্দেশখালিতে ইডি আধিকারিকদের উপর হামলা-সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের দাপুটে নেতা শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে। তার ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি উত্তম সর্দারও একইভাবে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে নারী নিগ্রহের গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।
প্রতিবাদে গ্রামের নারীরা বিক্ষোভ দেখান, থানা ঘেরাও করা হয়। হামলা চলে উত্তম ও অপর শাহজাহান ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা শিবু হাজরার বাড়িতে। এর পিছনে বিরোধীদের উস্কানি থাকার অভিযোগ তোলে শাসক দল। সিপিএমের সাবেক বিধায়ক নিরাপদ সর্দার ও বিজেপির বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক বিকাশ সিংকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সোমবার উত্তম ও বিকাশকে বসিরহাট আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক দুজনেরই জামিন মঞ্জুর করেন। এরপরই তৈরি হয় নাটকীয় পরিস্থিতি। জামিন পাওয়ার পর বিকাশকে অন্য একটি মামলায় আদালত চত্বর থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়। এতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা। পথ অবরোধ করে তারা।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, মূল অভিযুক্ত উত্তম কীভাবে জামিন পেয়ে গেলেন। জমিনের পর বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি থেকে নামিয়ে এই তৃণমূল নেতাকেও পুলিশ ফের গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ ওঠে, উত্তমকে নিজেদের হেফাজতে চায়নি পুলিশ। ভারসাম্যের খেলায় তারা একই ভূমিকা নিয়েছে বিকাশের ক্ষেত্রেও।
রাজ্য পুলিশ এই অভিযোগ খারিজ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দিয়েছে। তাদের দাবি, দুই অভিযুক্তের ক্ষেত্রেই ১০ দিনের পুলিশ হেফাজত চাওয়া হয়েছিল। আদালত জামিন দিয়েছে। এই দাবির পক্ষে টুইট বার্তার সঙ্গে আবেদনপত্রের প্রতিলিপি জুড়ে দিয়েছে পুলিশ।
উত্তম ও বিকাশের মতো একাধিক ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সাবেক বিধায়ক নিরাপদের নামে। তাকেও সোমবার বসিরহাট আদালতে পেশ করা হয়। নিরাপদকে তিন দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছেন বিচারক। ধৃত তিন গ্রামবাসীকে জামিন দিয়েছে আদালত।
বাম-বিজেপির বিক্ষোভ
দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে আজ বাম ও বিজেপির জোড়া কর্মসূচি রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে। দুই শিবিরের কর্মসূচির কেন্দ্রে পুলিশ সুপারের কার্যালয়। বিজেপির অফিস ঘেরাও ও সিপিএমের স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে ৫০০ মিটার বৃত্তে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এর ফলে এই এলাকায় চারজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ। এই বৃত্তের মধ্যে রয়েছে বসিরহাট আদালতও। বিভিন্ন রাস্তায় তৈরি করা হয়েছে ব্যারিকেড।
পুলিশের বাধা এড়াতে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কৌশল বদল করে রেলপথে বসিরহাটে পৌঁছন। সঙ্গে ছিলেন যুব মোর্চার সভাপতি ইন্দ্রনীল খান ও ৩০-৪০ জন কর্মী।
হৃদয়পুর স্টেশন থেকে তারা হাসনাবাদ লোকালে ওঠেন। বসিরহাট স্টেশন থেকে নিজেই বাইক চালিয়ে দলীয় কার্যালয়ে যান সুকান্ত। এ পর্যন্ত পুলিশ তার পথ আটকায়নি। এরপর হেঁটেই সুপারের কার্যালয়ের দিকে যান বিজেপি নেতৃত্ব।
ট্রেনে ওঠার আগে সুকান্ত বলেন, "সড়কপথে গেলে আমাদের ব্যারিকেড ভাঙতে হত। তাতে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়তেন। এই পরিস্থিতি এড়াতে আমরা ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।"
এর পাল্টা শাসক দলের প্রতিনিধিরা সন্দেশখালি গিয়েছেন। এর নেতৃত্বে রয়েছেন দুই বিধায়ক পার্থ ভৌমিক ও নারায়ণ গোস্বামী। পার্থ জানিয়েছেন, ১৪৪ ধারা যে এলাকায় রয়েছে, তার বাইরেই তারা সফর করবেন।
আগামিকাল সরস্বতী পুজো, তার পরের দিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সন্দেশখালি যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
আদালতের নজরে
সন্দেশখালির ঘটনায় আজ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করেছে। বিচারপতি অপূর্ব সিংহরায় চলতি ঘটনাক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য, "আদিবাসীদের জমি দখল ও ধর্ষণের অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক। এটাই হস্তক্ষেপের উপযুক্ত সময়।"
বিচারপতি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ বিষয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন। সিনিয়র আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কে এই মামলায় আদালত বান্ধব হিসেবে নিযুক্ত করেছেন বিচারপতি। সন্দেশখালির গোটা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছে আদালত।
সন্দেশখালির নারীদের অভিযোগ শুনতে আজ এলাকায় যায় রাজ্য সরকার গঠিত ১০ সদস্যের একটি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন ডিআইজি সিআইডি সোমা দাশগুপ্ত। ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশনের দুই সদস্যও কথা বলেন অভিযোগকারী নারীদের সঙ্গে। সফরে আসবে জাতীয় তফসিলি কমিশনও।
পর্যবেক্ষক, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "বাঙালি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে। গ্রামবাসী যে অভিযোগ এনেছেন, তা মারাত্মক। বুদ্ধিজীবীরাও নিরুত্তাপ। এরপর হয়তো লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সন্দেশখালি এডিশন হবে। আরো কিছু টাকা বাড়িয়ে দেয়া হবে, যাতে ভোট শাসক দলের পক্ষে পড়ে।"