থমথমে সন্দেশখালিতে ১৪৪ ধারা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবন লাগোয়া সন্দেশখালি বৃহস্পতিবার থেকে অগ্নিগর্ভ ছিলো। ফেরার তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ও তার দুই ঘনিষ্ঠ উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে নদী ঘেরা এই জনপদ। উত্তম ও শিবুর বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। শিবুর পোল্ট্রি ফর্মে আগুন দেয় উত্তেজিত জনতা।
জারি ১৪৪ ধারা
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ-প্রশাসন সন্দেশখালি থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। এর ফলেচারজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ। আজ শনিবার সকাল থেকে পুলিশ এলাকায় মাইকিং করে এই সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করছে। একইসঙ্গে সন্দেশখালির আটটি এলাকায় বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা।
এর ফলে সাধারণ মানুষকে গত দুদিনের মতো আজ পথে নামতে দেখা যায়নি। এলাকায় পুলিশ টহল দিচ্ছে। মোড়ে মোড়ে রয়েছে পুলিশ পিকেট। বারাসতের ডিআইজি সুমিত কুমার-সহ অন্যান্য পুলিশকর্তারা ঘটনাস্থলে রয়েছেন। ডিআইজির হুঁশিয়ারি, কোনও অশান্তি হলে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যদিও প্ৰত্যন্ত এলাকার কোনো কোনো গ্রামে মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তাদের অভিযোগ, গ্রামবাসীদের মারধর করছে, পাকড়াও করছে পুলিশ। শাহজাহানের বাহিনী হামলা চালাচ্ছে রাতে।গ্রামবাসীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে। আট গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশের হাতে 'আক্রান্ত'দের মধ্যে কর্মীরা রয়েছেন বলে দাবি বিজেপি নেতৃত্বের। আজ তাদের একটি প্রতিনিধিদল সন্দেশখালি গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের ছয় কিলোমিটার দূরে ধামাখালি রামপুরে আটকে দেয় পুলিশ। নেতাদের সঙ্গে পুলিশের বিতণ্ডা চলে দীর্ঘক্ষণ।
রাজভবনে বিজেপি
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপির বিধায়করা আজ রাজভবনে যান সন্দেশখালি নিয়ে নালিশ জানাতে। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাজভবনের ছিলেন না, তিনি কলকাতার বাইরে রয়েছেন।
রাজভবনের সামনে দাঁড়িয়ে শুভেন্দু বলেন, ১৪৪ ধারা জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে, আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার, ইন্টারনেট পরিষেবা চালু ও সন্দেশখালিতে আধাসেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
রাজ্যপালের প্রতি বিরোধী দলনেতার আর্জি, দ্রুত রাজ্যে ফিরে আগামীকালই সন্দেশখালি সফর করুন। দাবি পূরণ না হলে সোমবার থেকে বিজেপি বিধায়করা রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসবেন, বলে জানান শুভেন্দু।
এদিন কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত, দিল্লি থেকে তথ্য অনুসন্ধানী একটি দল পশ্চিমবঙ্গে আসবে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় দলটি ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালি যাবে।
তৃণমূল মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, "বারবার কেন্দ্রীয় দল আসে পশ্চিমবঙ্গে। উত্তরপ্রদেশে অপরাধ হলে দল পাঠানো হয় না। এ সব বিজেপির রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়।"
নারী নিগ্রহের অভিযোগ
শিবু হাজরা ও তার দলবদলের বিরুদ্ধে নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। মুখ খুলেছেন সন্দেশখালির বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, বাড়ির অল্প বয়সের মেয়ে ও বধূদের অনেক রাতে দলের বৈঠকে ডাকা হত। পুরুষ সদস্যরা প্রতিবাদ করলে তাদের হুমকি দেওয়া হত। অভিযোগ উঠেছে শ্লীলতাহানিরও।
গ্রামবাসীর দাবি, শিবুর বিরুদ্ধে নিগ্রহের অভিযোগ জানানোর সাহস ছিল না তাদের। উল্টে মীমাংসার জন্য গ্রামের মানুষজনকে শাহজাহানের কাছে যেতে বলা হত। রাজ্যপাল বোস নারীদের উপর নির্যাতনের অভিযোগের কথা জেনে ক্ষুব্ধ। তিনি দ্রুত নবান্নকে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন, এমনটাই খবর রাজভবন সূত্রের।
এই নারীরাই রয়েছেন সন্দেশখালির বিক্ষোভের সামনের সারিতে। দুদিন ধরে উত্তম ও শিবুর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুরের ক্ষেত্রেও পুরুষদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে গ্রামের নারীদের।
নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, "নারীদের এগিয়ে আসা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়। যখন পুরুষের উপর আস্থা হারিয়ে যায়, তখন নারীরাই মরিয়া হয়ে ওঠেন। প্রতিবাদে পথে নেমে আসেন। সেটাই দেখা যাচ্ছে সন্দেশখালিতে। অতীতেও এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে।"
মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী, এপিডিআর-এর রাজ্য সম্পাদক রঞ্জিত শূর বলেন, "নারী শুধু নয়, সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসা খুব আশাব্যঞ্জক। পুলিশ-প্রশাসন শাসকের সঙ্গেই থাকে, ৫০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে আমরা সেটাই দেখছি। তাই সাধারণ মানুষকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সন্দেশখালি সেই পথ দেখাচ্ছে।"
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ২৪ পরগনার সুটিয়া এলাকার স্মৃতি অনেকে ফিরিয়ে আনছেন। এখানে দিনের পর দিন নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল। এর প্রতিকারে আন্দোলন করতে গিয়ে খুন হন শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস।
শাশ্বতী বলেন, "সুটিয়ায় যা হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি এখানে যেন না নয়। প্রশাসনকেই এগিয়ে এসে নারীদের কাছ থেকে অভিযোগ নিতে হবে। আর যে মেয়েরা রাস্তায় নামছেন, তাদের বিরুদ্ধে যদি পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয়, সেক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে।"