1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

'সব ঝুট হ্যায়', সব মিথ্যা

গৌতম হোড়
১৫ মে ২০২০

ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে হিসাব মিলছে না। তাঁদের ঘরে ফেরানোর হিসাব। এমনকী তাঁদের বেঁচে থাকার হিসাবও।

https://p.dw.com/p/3cHLQ
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Shukla

অঙ্ক কী কঠিন। ছেলেবেলায় আমার মতো অনেকেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আর যদি সেটা রাজনীতির অঙ্ক হয়, তা হলে তো কথাই নেই। যেমন কঠিন, তেমনই গোলমেলে। অনেক সময় মনে হতেই পারে রুবিক কিউবের সমাধান করাটা এর থেকে অনেক সহজ। সেই অঙ্ক যদি আবার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে হয়, তা হলে আরও সমস্যা। সেই রাজনীতির অঙ্ক আরও ভয়ঙ্কর।

ভনিতা না করে সোজা কথায় আসি। পশ্চিমবঙ্গ দিয়েই এই গোলমেলে অঙ্কের দিকে তাকানো যাক। তারপর গোটা ভারতের অঙ্কে যাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত জন শ্রমিক কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যান বা গিয়েছিলেন? এর কোনও হিসাব রাজ্য সরকারের কাছে আছে কি? থাকলেও তাঁরা তা প্রকাশ্যে জানাননি। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকেরসংখ্যা ১০ লাখের কম নয়, বরং বেশি হবে। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় যত শ্রমিক বাইরে ছিলেন তাঁরা কেউই ফিরতে পারেননি। এরপরই সেই জটিল অঙ্ক শুরু।

ঢাকার বস্তিবাসীরা যেমন আছেন

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আপনার অঙ্ক আমি বুঝতে পারিনি। কেন্দ্রীয় সরকার যখন মে দিবস অর্থাৎ ১ মে থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালাতে শুরু করলো, তখন আপনি মাত্র দুইটি ট্রেন চাইলেন। একটি কেরল থেকে, অন্যটি রাজস্থান থেকে। কেন্দ্রের নিয়ম ছিলো, নিজের রাজ্যের শ্রমিককে নিয়ে আসার জন্য রেলমন্ত্রকের কাছে রাজ্য সরকারকে টাকা জমা করতে হবে। দুইটি ট্রেনে কতজন শ্রমিক ফিরলেন? দুই হাজার ৪০০ জন। তারপর রাজ্য সরকার চুপচাপ বসে থাকলো। বিতর্ক বাড়লো। দিল্লিতে বসে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী প্রায় প্রতিদিন ট্রেনের দাবি করতে লাগলেন। এমনকী অমিত শাহ চিঠি দিয়ে বললেন, ট্রেন কেন এত কম নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ? তার আগে বা পরে রাজ্য সরকার আরও দশটি ট্রেন বুক করলো। আর আপনি রাজ্যের বিষয়ে নাক গলাবার জন্য অমিত শাহের প্রবল সমালোচনা করলেন। পরের দশটি ট্রেনে কতজন শ্রমিক ফিরলেন? ১২ হাজার। এখন আপনি বলছেন, আরও ১০৫টি ট্রেন বুক করা হয়েছে। এর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণ হয়? তার আগে আপনি বলেছিলেন, এক লাখ লোক, হেঁটে, বাসে, গাড়িতে করে রাজ্যে এসে গেছেন। এই ১০৫টি ট্রেনে করে এক লাখ ২৩ হাজারের মতো পরিযায়ী শ্রমিক ফিরতে পারবেন। তা হলে এখনও কত শ্রমিক বাকি থাকলো? তার সংখ্যাটাও কয়েক লাখ হওয়ার কথা। তাঁদের কী হবে? তাঁরাও কি আগের শ্রমিকদের মতো হেঁটে, বাসে, গাড়িতে ফিরবেন? আর আপনি যদি জানতেনই এত শ্রমিক বাইরে আছে, তা হলে প্রথমে মাত্র দুইটি ট্রেন কেন বুক করলো রাজ্য সরকার? সমালোচনার পর দশটি। তারপর একধাক্কায় ১০৭টি। প্রথমেই তো বলে নেওয়া যেত, রাজ্যের অন্তত ১২৫টি ট্রেন চাই।  ধাপে ধাপে ট্রেন বাড়ানোর রহস্যটা কী?

ছেলেবেলায় একটা অঙ্ক কষতে হতো, তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামা। একটা সময়ের মধ্যে বাঁদরটি তিন পা ওঠে, দুই পা পড়ে যায়। তারপর চূড়ায় কখন পৌঁছবে? সেরকমই জটিল অঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের এই ট্রেন চাওয়া। অথচ, আমরা জানি গরিবদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নিখাদ সহানুভূতি আছে। তা হলে এই গরিব শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরানো নিয়ে এরকম গোলমেলে অঙ্ক কেন? গরিব মানুষগুলোকে আনার, তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করার চাপ নিতে অনীহা? না কি, করোনা বেড়ে যাওয়ার ভয়? এর কোনওটাই তো সাধারণ মানুষের প্রাণ ও কষ্টের থেকে দামী নয়। না কি, ভোট যখন হবে, তখন এঁরা আবার ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে চলে যাবেন, তাই। কোনও সন্দেহ নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও গ্রামের দিকে সব চেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি যদি কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাওয়া মানুষগুলিকে প্রথম থেকে দেখতেন, তা হলে তাঁর সেই জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছুঁতো। তা না করে, বিজেপিকে থালায় করে একটা সুযোগ কেন দিতে গেলেন তিনি? অঙ্কটা যে কিছুতেই মিলছে না।

এ বার আসি কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্কের কথায়। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেছেন, পরিযায়ী শ্রমিক সহ গরিবদের আরও দুই মাস বিনা পয়সায় খাদ্যশষ্য দেওয়া হবে। পাঁচ কিলো চাল, গম ইত্যাদি। দেশের মোট ৮ কোটি মানুষ এই সুবিধা পাবেন। তার জন্য তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। যোজনা কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক ও পরিকল্পনা বিশারদ অমিতাভ রায় অঙ্ক কষে জানিয়েছেন, প্রতিদিন পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ হবে সাত টাকা ৩০ পয়সা। তবে এই খরচটাও নতুন করে খুব বেশি করতে হবে না। চাল, গম এফসিআই এর গুদামে উপচে পড়ছে। তারই একটা অংশ বিলি করা হবে। রাজ্যগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার যা খরচ। এখানে অঙ্কটা তো অন্য জায়গায়। পরিযায়ী শ্রমিকরা আগে নিজের রাজ্যে পৌঁছতে পারবেন, তবে তো সেই বিনি পয়সার রেশন পাবেন। কয়েকশ থেকে হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে, ট্রাকে চড়ে, তাঁদের বাড়ি পৌঁছতে হচ্ছে। পথের মধ্যে অনেকে মারা যাচ্ছেন। শুক্রবার ভোররাতেও উত্তর প্রদেশে তিনটি দুর্ঘটনায় ছয় জন মারা গিয়েছেন। তার আগের দিন মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন। মধ্য প্রদেশের সীমান্তে পুলিশের সঙ্গে শুক্রবার তাঁদের সংঘর্ষ হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে এই ঘটনা ঘটছে। পিং পং বলের মতো পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে যেন খেলা চলছে।

Goutam Hore
ছবি: privat

এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার তো আগে তাঁদের বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারতো। বলতে পারতো, কাউকে হেঁটে যেতে হবে না। সরকার ব্যবস্থা করবে বাস, ট্রাক বা অন্য বাহনের। যাতে করে পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের গ্রামে ফিরতে পারবেন। দেশভাগের পরবর্তী ইতিহাসে লাখো মানুষকে এই ভাবে ঘরে ফেরার জন্য কষ্ট ভোগ করতে হয়নি। এই ভাবে মারা যেতে হয়নি। এই ভাবে শুধু সংখ্যা হয়ে বেঁচে থাকতে হয়নি। দুই দিন আগে রেলমন্ত্রক দাবি করেছে, তারা দশ লাখ পরিযায়ী শ্রমিককে রাজ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে যে কথাটা নেই, তা হলো, কড়ায় গণ্ডায় টিকিটের দাম নিয়ে তবেই ট্রেন চলেছে। খাবার, জল পর্যন্ত রেল দেয়নি। তাই অঙ্কটা মিলছে কোথায়?

হাজার হাজার মানুষ এখনও হেঁটে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন কি না জানেন না। এই চড়া রোদে, গরমে, অনেক ক্ষেত্রেই শুধু জল ও কয়েকটা বিস্কিট খেয়ে শয়ে শয়ে কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছেন। এরপরেও কী করে বেঁচে বাড়ি ফিরতে পারছেন, সেটাই তো রহস্য। আমরা শুধু হিসাব শুনে যাচ্ছি, ট্রেনের সংখ্যার হিসাব, হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব। আর মাথার মধ্যে ক্রমাত ঘুরতে থাকছে, ক্ষুধিত পাষাণের মেহের আলির সেই অমর সংলাপ, 'সব ঝুট হ্যায়।'