সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার বছরে স্বজনদের লড়াই
২১ অক্টোবর ২০২৪রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্স, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ১০ বছরে প্রাণ হারিয়েছে ২৬ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী - ২০১৪ সালে ১ জন, ২০১৫ সালে ৪ জন সাংবাদিক ও ১ জন সংবাদকর্মী, ২০১৬ সালে ১ জন, ২০১৭ সালে ২ জন, ২০১৮ সালে ১ জন, ২০১৯ সালে প্রাণ হারায়নি কোনও সাংবাদিক, ২০২০ সালে ১ জন, ২০২১ সালে ৩ জন, ২০২২ সালে ১জন, ২০২৩ সালে ৩ জন, এবং ২০২৪ সালে ৭ জন সাংবাদিক ও ১ জন সংবাদকর্মী৷
১০ অক্টোবর দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে বাসায় ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷
১২ অক্টোবর ময়মনসিংহের সদর উপজেলায় বাড়ির সামনে তারাকান্দা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি স্বপন কুমার ভদ্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ পরের দিনই হত্যায় অভিযুক্ত সাগর মিয়াকে আটক করে পুলিশ৷ সাগরের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, পূর্ববিরোধের জের ধরে হত্যা করা হয় অবসরে যাওয়া সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্রকে৷ কর্মরত থাকা অবস্থায়, তিনি মাদকের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে পত্রিকায় লিখতেন৷ আসামি সাগরের মাদকসেবন এবং মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ৷
২৭ আগস্ট দিবাগত রাতে হাতিরঝিল থেকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে নারী সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর লাশ৷ রাহনুমার পরিবার তার এই রহস্যজনক মৃত্যুতে, একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন থানায়৷
তবে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্মরত অবস্থায় নিহত পাঁচ সাংবাদিকের হত্যা মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ৷ রিপোর্টাস উইদআউট বর্ডার্সের তথ্য মতে, ১৮ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ী জেলায় ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ৷ পরদিন ভোরের আওয়াজ পত্রিকার প্রতিবেদক শাকিল হোসেন এবং দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রতিবেদক আবু তাহের মো. তুরাব দুজনকেই সিলেট শহরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ একই দিনে ঢাকায় সংবাদ সংগ্রহের সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়র৷
৪ আগস্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সাংবাদিক হত্যার নিন্দা জানিয়ে দাবি করেন, দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিককে৷ তিনি সিপিবির সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য ও রায়গঞ্জ উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং রায়গঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷
মামলা দায়ের করতেই প্রায় এক মাসের অপেক্ষা
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের অস্থিতিশীল আবস্থায় ক্ষুদ্ধ বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে পুলিশ৷ এ কারণে, আন্দোলন চলাকালে নিহত সাংবাদিকদের বিচার চেয়ে হত্যা মামলা দায়ের করতেও দেরি হয় নিহতদের পরিবারের৷
১৯ আগস্ট অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নিহত আবু তাহের মো. তুরাবের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ৷ এর আগে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করলেও পুলিশ এটিকে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হিসেবে গ্রহণ করে৷
অন্যদিকে, ২০ আগস্ট ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়র হত্যা মামলা দায়ের করতে গেলে নিহতের মা সামসি আরা জামানকে প্রায় ১২ ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয় নিউমার্কেট থানায়৷
এই হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ ডয়চে ভেলেকে জানান, প্রিয়র মা মামলা করতে থানায় গেলে বিভিন্ন অজুহাতে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি৷ সকাল ১১ টায় থানায় গেলেও, মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতার চাপে মামলা নিতে বাধ্য হয় পুলিশ৷ এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত অজ্ঞাতনামা ৩০-৪০ জন পুলিশ এবং বিজিবি বাহিনীর কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়৷
এরও এক মাস পর ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত সাংবাদিক মেহেদী হাসানের বাবা মোশাররফ হোসেন৷ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজার আদালত যাত্রাবাড়ী থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন৷
সহকর্মীর প্রাণ বাঁচিয়ে মারা গেলেন মেহেদি
১৮ জুলাই দুপুরে টিএসসিতে ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র ফটোসাংবাদিক রোহেত রাজিব৷ যাত্রাবাড়ি এলাকায় পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন রোহেত৷ যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার টোল প্লাজার কাছেই ছবি তোলার সময় উড়ে আসা ইটের আঘাতে পথেই লুটিয়ে পড়েন এই ফটো সাংবাদিক৷
রোহেত রাজিব ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি ছবি তোলার সময় আমার পায়ে একটি আঘাত লাগে৷ সাথে সাথে পথেই পড়ে যাই৷ আমি উঠে দাঁড়াতে পাড়ছিলাম না৷ তখন পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্য সংঘর্ষ চলছে৷ চারিদিকে এলোপাথারি গোলাগুলি হচ্ছিল৷ ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদি দৌড়ে এসে আমাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যায়৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকটা জায়গা বয়ে নিয়ে যায় মেহেদি৷ তারপর রাস্তার পাশে একটা জায়গায় বসিয়ে পানি খাওয়ায়৷ এবং আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়িতে তুলে দেয় সে এবং ফিরে যায় সংবাদ সংগ্রহে৷ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর জানতে পারি আমার পায়ের হাঁড় ভেঙে গেছে৷ ঘণ্টা খানেক পরে বাসায় এসে ফেসবুকে একটা পোস্টে দেখি যাত্রবাড়িতে একটা ছেলের মৃত দেহ পড়ে আছে৷ চিনতে অসুবিধা হয়নি৷ এটা তো আমাদের মেহেদি, যে কিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে৷ কয়েক ঘণ্টা পরেই সে নিজেই মরে পড়ে থাকে রাস্তায়৷ বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ মেহেদি না থাকলে হয়তো আমি নিজেই ঐদিন মারা পড়তাম৷’’
‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো’
‘‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো'', তাহির জামান প্রিয় মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ এই বাক্যটি বলেছিলেন বন্ধু সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎকে৷ তারপরেই পুলিশের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন প্রিয়৷
মানবাধিকারকর্মী সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ ডয়চে ভেলেকে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে ১৯ জুলাই সকালে সংসদ ভবনের সামনে যান তিনি৷ পুলিশ সেখানে দাঁড়াতে না দিলে, দুপুরের পরে নিউমার্কেটের সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় যান তারা৷ সেখানেই প্রিয়র সাথে দেখা হয় ফারিয়া উলফাৎ-এর৷
ফারিয়া উলফাৎ বলেন, ‘‘সায়েন্স ল্যাবরেটরি সীমানা সংলগ্ন ল্যাবএইড সেন্ট্রাল রোড এলাকায় ছাত্র- জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম৷ সাথে প্রিয়ভাই ছিল ছবি তোলার কাজে৷ একসময় এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে গুলি করতে থাকে পুলিশ৷ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশের একটি দল দ্রুত পিছন থেকে গ্রিনরোডের মুখে চলে আসে৷ আমরা সবাই পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ি৷ অন্যদিকে, আকাশে নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার ও ড্রোন থেকে আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিল৷ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গুলির শব্দ৷ এ সময় পুলিশের একটি দল সায়েন্স ল্যাবের দিক থেকে এবং অপর একটি দল ল্যাব এইডের দুই ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে সেন্ট্রাল রোডের দিকে এগিয়ে আসে৷ তখন প্রিয় ভাই বলছিলেন, ‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো৷' মুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই৷ ভেবেছিলাম সাউন্ড গ্রেনেড৷ দৌঁড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ সবার পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম আমি৷ বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম পুলিশের অবস্থান দেখার জন্য৷ টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় প্রথমে বুঝতে পারিনি৷ তারপর দেখি পেছনে একজন পড়ে আছে৷ মানুষটার মাথার চারিদিকে অনেক রক্ত৷ ধোঁয়া সরে যেতেই দেখি পড়ে থাকা বডিটা প্রিয় ভাইয়ের, তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে৷ ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আবার গুলি ছুড়তে থাকে৷ আনতে পারিনি তাকে৷ প্রিয় ভাইয়ের দেহটা রাস্তায় পড়ে থাকে৷’’
এফআইআর তথ্য থেকে জানা যায়, অজ্ঞাতনামা ৪-৬ জন আন্দোলনকারী ছাত্র প্রিয়র মৃতদেহ ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আইডিয়াল কলেজ রাস্তা দিয়ে যাওয়ারর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু পুলিশের অনবরত গুলির মুখে প্রিয়র মৃতদেহটি ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় তারা৷
ফারিয়া উলফাৎ আরো বলেন, ‘‘হয়তো অল্প কয়েক ইঞ্চির জন্য গুলিটা আমার মাথায় না লেগে প্রিয় ভাইয়ের মাথায় লাগে৷ গুলি লাগার আগ মুহূর্তে প্রিয় ভাই বলেছিলেন ‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো৷' বারবার আমার এই কথাটা মনে পড়ে৷ আমি অনেকদিন ঘুমাতে পারিনি এই ঘটনার পরে৷ আমার মধ্যে এক ধরনের সার্ভাইভাল গিল্ট কাজ করে৷ আমাকে ঐদিন নিজের জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে পালাতে হয়েছিল৷ একসাথে আমাদের আর থাকা হয়নি৷’’
‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে'
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংবাদিক হত্যা অনাকাঙ্খিত৷ সাংবাদিকরা প্রফেশনাল কাজে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে যায়৷ সেখানে তাদের হত্যা হলে, সেটা অনাকাঙ্খিত এবং এই হত্যার জোরালো বিচার আমরা দাবি করি৷ সুষ্ঠু বিচারের আওতায় এনে, যে দোষী হবে, তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে৷’’
তিনি আরো বলেন, আগামিতে এবং বর্তমান সরকারের আমলেও সাংবাদিকরা যেন সুষ্ঠু পরিবেশে তাদের সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে পারে, ন্যায়-নিষ্ঠ, অবজেক্টিভ রিপোর্ট করতে পারে – এটাই সরকারের প্রতি আমার আহ্বান৷ দেশের চলমান পরিস্থিতিতে, মানুষ আইনের সহায়তা পাচ্ছে না৷ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই, চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি ঘটে যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় বর্তমান সরকারের প্রতি আমার আহ্বান, তারা যেন সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে৷ আর আইন- শৃঙ্খলাবাহিনীকে বলবো, সাংবাদিক যদি কোথাও সংবাদ সংগ্রহে যায়, তারা যেন অবশ্যই সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টি কনসিডার করে৷ সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহে যাবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে এটাই আমাদের কাম্য৷’’