সমস্যা সংগঠনে, না ভাবনায়?
২৭ মে ২০১৯প্রবল সমালোচিত হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ এবারের লোকসভা ভোটে রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ যে হয়েছে, বাংলায় কার্যত অস্তিত্বহীন, গুরুত্বহীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যে শক্ত জমি পেয়ে গেছে, ভোটের ফলাফলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মমতা ব্যানার্জির থেকে আরো একটু পরিণত প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল রাজনৈতিক মহল৷ কিন্তু তিনি করে বসলেন নিতান্ত আলগা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য৷ মুসলিম ভোট যে তৃণমূল পেয়েছে, কিন্তু হিন্দু ভোটের এক বড় অংশ বিজেপির গেরুয়া ঝুলিতে জমা হয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আমি বেশ করি ইফতারে যাই৷ একশ বার যাবো৷ যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি খাওয়া যায়!''
এই মন্তব্যে তৃণমূল নেত্রী প্রকাশ করে দিলেন যে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের তিনি দুধ দেওয়া গরু, অর্থাৎ, ভোট দেওয়া জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না৷ এতে যেমন তাঁর বা তাঁর সরকারের মান বাড়ল না, রাজ্যের সংখ্যালঘুদেরও প্রাপ্য মর্যাদা দিতে তিনি ব্যর্থ হলেন৷ গত শনিবার, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনি ব্যর্থতার পর্যালোচনা এবং প্রথমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার পর আর যা যা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, ওই আলটপকা মন্তব্যের পর তার কোনো কিছুই আর গুরুত্ব পায়নি৷ তিনি বলেছেন, সরকারে বেশি সময় দেওয়া হয়ে গেছে, দলকে সময় দেওয়া হয়নি (অর্থাৎ, তাই এই নির্বাচনি বিপর্যয়)৷ বলেছেন, সংগঠনে সময় দেবেন বলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু দল রাজি হয়নি৷
এই মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি একদা মমতা ব্যানার্জির সবথেকে বিশ্বস্ত সেনাপতি, দল ছেড়ে এখন রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে থাকা মুকুল রায়৷ পশ্চিমবঙ্গে এবার লোকসভা ভোটে বিজেপির তাক লাগানো সাফল্যের নেপথ্য কারিগর মনে করা হচ্ছে মুকুল রায়কেই৷ মনে করা হচ্ছে, এবার তাঁর সুতোর টানেই তৃণমূলের অনেক নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক শিবির বদলে বিজেপিতে যোগ দেবেন, যার পরিণতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার পড়েও যেতে পারে! মুকুল রায় বলেছেন, ইস্তফা দিতে চাওয়ার ব্যাপারটা স্রেফ নাটক৷ দল বলতে তো উনি একাই৷ তা হলে কি নিজেই নিজের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন এবং নিজেই সেটা খারিজ করেছেন? মুকুলের এই রসিকতার লাগোয়া মন্তব্যটি কিন্তু প্রনিধানযোগ্য৷ মুকুল বলেছেন, মমতা ক্ষমতালোভী৷ মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকার যে অপরিসীম ক্ষমতা, তা তিনি পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করেন৷ তাই তিনি কখনোই ইস্তফা দেবেন না৷ যতক্ষণ না রাজ্যের জনগণ তাঁকে গদি ছাড়তে বাধ্য করছে৷
বলা বাহুল্য যে, বিজেপির পরের লক্ষ্য এখন ঠিক সেটাই৷ তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারকে হটিয়ে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করা৷ পূর্ব ভারতে ত্রিপুরা এবং অসমে সরকার গড়ার পর পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি সরকার৷ বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে এটা এখন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সুদূর গুজরাটে বিজয় উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়েও নরেন্দ্র মোদী জনতার উদ্দেশে বলেছেন, এত জোরে ‘ভারতমাতা কি জয়' বলুন যাতে বাংলায় বসেও শোনা যায়! এবং এই জাতীয়তাবাদী হাওয়া যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পালে বাতাস দিয়েছে, ভোটের ফলেই সেটা স্পষ্ট৷ তৃণমূল কংগ্রেস এ যাত্রায় রাজ্যে তাদের ৪৩% ভোট ধরে রাখতে পারলেও বিজেপি তাদের ভোট বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করে নিয়ে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে৷ উত্তরবঙ্গ থেকে কার্যত উধাও হয়ে গেছে তৃণমূল৷ তাদের জেতা ৮টি লোকসভা আসনের ৭টিই কেড়ে নিয়েছে বিজেপি৷ প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া জঙ্গলমহলেও তৃণমূলকে হটিয়ে দিয়েছে বিজেপি এবং তাদের হিন্দু–হিন্দি রাজনীতি৷ আসানসোল–দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চলের দুটি আসনও দখল করেছে বিজেপি৷ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া দক্ষিণ বঙ্গেও গেরুয়া বাহিনী ঢুকে পড়েছে এবং আসামের মতো নাগরিক তালিকা সংশোধনের কাজ সম্ভবত শুরু হবে এখান থেকেই৷ সব মিলিয়ে বিজেপি যে ১৮টি আসন এবার জিতে নিয়েছে, তার আওতায় পড়ছে ১৩৭টি বিধানসভা কেন্দ্র৷ ২৯৪ আসনের রাজ্য বিধানসভায় যেটা তৃণমূল সরকারের পক্ষে রীতিমতো ভয় ধরানো ৪৬.৫৯%৷ এবং মমতা ব্যানার্জি হিসেব করে দেখেছেন, এর মধ্যে ১২৯টিতেই গণনার সময় এগিয়ে থেকেছেন বিজেপি প্রার্থীরা৷ আরো ৬০টি বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান চার হাজারেরও কম৷ উত্তরবঙ্গ ও রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ১৯২টি এমন বিধানসভা এলাকা চিহ্নিত করা গেছে, যেখানে দ্রুত রাজনৈতিক জমি হারাচ্ছে তৃণমূল৷ ফলে এখন দলের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক খুঁজতে তৎপর হয়েছেন নেত্রী এবং নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, কারা গোপনে বিজেপির হয়ে কাজ করল খুঁজে বের করতে৷
অথচ এবারের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য মমতার স্লোগান ছিল— বোল্লিশে বেয়াল্লিশ৷ অর্থাৎ, রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের সবকটিতেই তিনি জিততে চেয়েছিলেন৷ ভোটারদের উদ্দেশে খোলাখুলি আবেদন জানিয়েছিলেন, বিজেপিকে তো নয়ই, অন্য দুই বিরোধী দল কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকেও যেন কেউ ভোট না দেয়৷ ‘‘ওদের ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করবেন না৷'' বলেছিলেন নেত্রী৷
ফল ঘোষণার পর থেকেই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা রাজ্যে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির জন্য দায়ী করছিলেন মূলত বামেদের, যে সম্ভাবনা আগেই ধরা পড়েছিল৷ সিপিএম-এর পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাট যা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তুমুল সমালোচিত হয়েছিলেন রাজ্যের বাম নেতাদের কাছে৷ নেতারা বলেছিলেন, কারাটের মন্তব্য ভুল বার্তা দেবে বাম ভোটারদের৷ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, শারীরিক কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে কার্যত অবসর নেওয়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বাম ভোটারদের সতর্ক করতে বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে শিক্ষা দিতে বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতানো মানে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেওয়া৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, রাজনৈতিক বিরোধীদের খতম করতে এবং একচেটিয়া শাসন কায়েম করতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করার ক্ষমতা যেহেতু এই মুহূর্তে একমাত্র বিজেপিরই আছে, জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেওয়া এবং তজ্জনিত গাত্রদাহ সহ্য করতেও বাংলার ভোটাররা রাজি৷ কিন্তু তার মধ্যেই তলায় তলায় ঘটে গেছে বিপজ্জনক এক অবস্থান বদল৷ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে সন্দিহান বাঙালির মধ্যে অবশেষে প্রকট হয়ে উঠল ধর্মীয় বিভাজন৷ হিন্দু ভোটের এক বড় অংশ সফলভাবে নিজেদের দিকে টেনে নিলো বিজেপি৷ মমতা ব্যানার্জির হাতে রইলো সংখ্যালঘু ভোট এবং অদূর ভবিষ্যতে নিজের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে ধস নামার সমূহ সম্ভাবনা৷