সম্মানরক্ষার লড়াইয়ে শরদ, উদ্ধব, যোগী আদিত্যনাথ
১২ নভেম্বর ২০২৪বুধবার ঝাড়খণ্ডে প্রথম পর্যায়ের ভোট। ২০ তারিখ ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায় এবং মহারাষ্ট্রের বিধানসভার ভোটগ্রহণ। বুধবারই ১৪টি রাজ্যে ৪৭টি বিধানসভা ও দুইটি লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হবে কেদারনাথ কেন্দ্রে ভোট হবে ২০ তারিখ।
ভারতের এতগুলি রাজ্যের মানুষ আবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তাই দুইটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং ১৪টি রাজ্যের উপনির্বাচন রীতিমতো গুরুত্ব পাচ্ছে। তাছাড়া ভারতের আর্থিক রাজধানী বলে পরিচিত মুম্বই যে রাজ্যে, সেই মহারাষ্ট্রে ভোট হচ্ছে। এই মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ও শরদ পাওয়ারের এনসিপি ভেঙে একনাথ শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জোটকে ধরাশায়ী করেছিল উদ্ধব-পাওয়ার-কংগ্রেস জোট। এবার বিধানসভাতে জিতে বিজেপি-র বিরুদ্ধে কি প্রতিশোধ নিতে পারবেন উদ্ধব, শরদ পাওয়ার?
মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতি
শরদ পাওয়ারকে বলা হয় ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য। চারবার তিনি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, কেন্দ্রে প্রতিরক্ষা, কৃষি-সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। ২৪ বছর মহারাষ্ট্রে বিধায়ক ছিলেন। লোকসভার সাংসদ ছিলেন, এখন তিনি রাজ্যসভার সাংসদ । আইসিসি-র সভাপতি পদেও থেকেছেন। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হওয়া ছাড়া একজন ভারতীয় রাজনীতিক যে স্বপ্ন দেখেন তার সবই করেছেন শরদ পাওয়ার।
এহেন শরদ পাওয়ারের দল ভেঙেছে বিজেপি। ভাইপো অজিত পাওয়ার কিছু বিধায়ককে নিয়েআলাদা হয়ে গেছেন। রাজনৈতিক জীবনের শেষের দিকে এসে শরদও চাইবেন, তার ও দলের প্রভাব অক্ষুন্ন রেখে নিজের রাজনৈতিক শক্তির পরীক্ষায় জিততে।
উদ্ধব ঠাকরের কাছে তো এটা অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। বিজেপি তার শিবসেনায় ভাঙন ধরিয়েছে তাই নয়, বালাসাহেব ঠাকরের ছেলেকে এখন লড়তে হচ্ছে, মূল শিবসেনা দলের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। একনাথ শিণ্ডে তার অনেক ঘনিষ্ঠ নেতাকে নিয়ে দল ছেড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। লোকসভায় নিজের শক্তি দেখানোর পর উদ্ধব ঠাকরে বিধানসভা ভোটেও আবার নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছেন। তাই এই বিধানসভা নির্বাচন শরদ পাওয়ার ও উদ্ধবের কাছে নিছক একটা ভোট নয়, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বের।
কংগ্রেসও পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া। হরিয়ানায় দলের নেতারা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করে দলের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে এখনো পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে নানা পাটোলে, পৃথ্বীরাজ চৌহানরা প্রকাশ্যে অন্তত হরিয়ানার পথে হাঁটেননি।
অন্যদিকে একবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মহারাষ্ট্রের মতো বড় রাজ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া একনাথ শিন্ডেও আবার মুখ্যমন্ত্রী হতে মরিয়া। অজিত পাওয়ারও প্রমাণ করতে চান, কাকার ছত্রছায়ার বাইরে তার নিজের রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আর দেবেন্দ্র ফড়নবিসকে সামনে রেখে মোদী-শাহ প্রমাণ করতে চান, তাদের রাজনৈতিক কৌশলের জোর এখনো যথেষ্ট।
মহারাষ্ট্রের প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল চাওকে ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''লোকসভায় দেখা গিয়েছে, মানুষ একনাথ শিণ্ডের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। লোকসভার পর রাজ্য সরকার সামাজিক প্রকল্পে প্রচুর টাকা ঢেলেছে। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা মাজি লড়কি বহিন যোজনা চালু করে রাজ্যের দুই কোটি ৩৪ লাখ নারীকে মাসে দেড় হাজার টাকা দিয়েছে। তিন মাসের টাকা মেয়েরা পেয়ে গেছেন।''
সুনীল বলেছেন, ''আবার সয়াবিন ও তুলোর ফসলের দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। দাম না পাওয়ার ক্ষোভ পেঁয়াজ চাষীদেরও আছে। এখন প্রতিমাসে মেয়েদের এই দেড় হাজার টাকা দেয়ার ফলে সেই ক্ষোভ প্রশমিত হবে কি না, সেটা ভোটের ফল বলবে।''
শিণ্ডে ইতিমধ্যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আবার ক্ষমতায় এলে এই অর্থের পরিমাণ দুই হাজার একশ টাকা করা হবে। আর উদ্ধবদের জোটের প্রতিশ্রুতি, তারা ক্ষমতায় এলে মেয়েদের মাসে তিন হাজার টাকা দেবেন।
এর পাশাপাশি শরদ পাওয়ার ও উদ্ধব ঠাকরে মারাঠি অস্মিতার প্রশ্ন তুলছেন। যেভাবে বিজেপি তাদের দল ভাঙিয়েছে, সেটাকে এই রাজনৈতিক মোচড় দিয়ে তারা মারাঠা ভোটব্যাঙ্ককে প্রভাবিত করতে চাইছেন।
আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মহারাষ্ট্রে গিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, 'এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়'। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, আরএসএস ৬৫টি সংগঠনের সঙ্গে মিলে মানুষের কাছে গিয়ে সজাগ থাকতে বলছে।
ঝাড়খণ্ডের লড়াই
ঝাড়খণ্ডের পরিস্থিতিও রাজনৈতিক থেকে খুবই কৌতূহলকর। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন হেমন্ত সোরেন। চম্পাই সোরেন তখন মুখ্যমন্ত্রী হন। জামিন পেয়ে হেমন্ত আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আর চম্পাই সোরেন যোগ দিয়েছেন বিজেপি-তে।
ঝাড়খণ্ডের লড়াইয়ের একটা অভিনব দিক আছে। ঝাড়খণ্ডের ভোট বুঝতে গেলে যেটা বোঝা জরুরি। এই রাজ্যে জনজাতিদের সংরক্ষিত আসনে জেএমএম ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বিজেপি শক্তিশালী হয়েছে। বিহার-ঘেঁষা এলাকায় বিজেপি যথেষ্ট শক্তিশালী।
লোকসভার ফলাফলের নিরিখে বিজেপি ৫২টি ও ইন্ডিয়া জোট ২৯টি আসনে এগিয়ে আছে। আবার গত বিধানসভার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি উত্তর ছোটনাগপুর ও পালামৌতে এগিয়ে ছিল। কিন্তু সাঁওতাল পরগনা, দক্ষিণ ছোটনাগপুর ও কোলহানে এগিয়ে ছিল জেএমএম জোট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমিতাভ তিওয়ারি লিখেছেন, বিজেপি-কে জিততে গেলে সাঁওতাল পরগনা ও কোলহানে ভালো ফল করাটা জরুরি।
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটের ধাক্কা সামলাতে হয়। হেমন্ত সোরেনকে সেটা সামলাতে হবে। এখানেও ভালো লড়াই হবে। তবে বিজেপি-র কাছে সম্ভবত মহারাষ্ট্রের লড়াই আরো কঠিন।''
উপনির্বাচনের গুরুত্ব
যে ১৪টি রাজ্যে ৪৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে তার মধ্যে আছে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরাখণ্ড, কর্ণাটক, কেরালা, বিহার, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য।
উত্তরপ্রদেশে নয়টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে। সাধারণত, মুখ্যমন্ত্রীরা উপনির্বাচনে প্রচার করেন না। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ করছেন। কাটেহারিতে তিনি গত দুই মাসে তিনটি জনসভা করেছেন। এই কেন্দ্রকে বলা হয় দলিত রাজনীতির ল্যাবরেটরি। পাঁচবার বিএসপি জিতেছে এই কেন্দ্র থেকে। দুইবার সমাজবাদী পার্টি। সেই কেন্দ্র ছিনিয়ে এনে য়োগী আদিত্যনাথ নিজের শক্তি দেখাতে চাইছেন। লোকসভায় যোগীরাজ্যে বিজেপি-র ভরাডুবি হয়েছিল। এবার তাই সবকটি আসনে জিততে চান যোগী।
কর্ণাটকে যেমন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কংগ্রেসকে প্রমাণ করতে হবে তাদের জনপ্রিয়তায় ধাক্কা লাগেনি। একই পরীক্ষা রাজস্থান, মদ্যপ্রদেশে বিজেপি-কে দিতে হবে।
ওয়েনাড়ে প্রিয়ঙ্কা
মঙ্গলবার ভারতের অনেক কাগজেই একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বোন প্রিয়ঙ্কার গালে স্নেহচুম্বন করছেন দাদা রাহুল। ওয়ানাড়ে প্রচারের শেষদিনে।
কেরালার এই কেন্দ্রে কিছুদিন আগেই রাহুল বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। তবে তিনি রায়বেরিলি ধরে রেখেছেন। ওয়ানাড় ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানেই দাঁড়িয়েছেন প্রিয়ঙ্কা। এই প্রথম তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সেটাও কংগ্রেসের কাছে খুবই নিরাপদ আসন বলে পরিচিত ওয়ানাড় থেকে। তাও তিনি এখানে প্রচারের ঝড় তুলেছেন। দাদা রাহুল তো বটেই, কংগ্রেসের ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই প্রিয়াঙ্কার প্রচারে ব্যস্ত থেকেছেন।
শরদ জানিয়েছেন, ''এরপরেও যদি প্রিয়াঙ্কাকে লোকসভায় দেখা না যায়, সেটা হবে সবচেয়ে বড় অঘটন।''