সরকারি পাটকল যুগের অবসান
৩ জুলাই ২০২০২৫টি পাটকল বন্ধের ফলে ২৫ হাজারেরও বেশি স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারালেন৷ সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, স্থায়ী শ্রমিকদের আগামী দুই মাসের মধ্যে শ্রম আইন অনুযায়ী সব পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দেয়া হবে৷ এজন্য সরকারের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে৷ তবে অস্থায়ী এবং বদলি শ্রমিকরা এই বন্ধের ফলে বাড়তি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না৷
সরকার অব্যাহত লোকসান দেখিয়েই রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করলো৷ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ জুটমিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪৮ বছরে মাত্র চার বার পাটকলগুলো লাভ করতে পেরেছে৷ ৪৪ বছরই লোকসান দিয়েছে৷ বর্তমানে এর পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যদিও বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করছে৷
পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘শ্রমিকদের দুই ধাপে পাওনা পরিশোধ করা হবে৷ আর পিপিপি'র আওতায় আধুনিকায়ন করে পাটকলগুলো আবার চালু হবে৷ তখন এই শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পাবেন৷
শ্রমিক পল্লীতে কান্না
১ জুলাই থেকে বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও পাটকলগুলো ২ জুলাই রাতে বন্ধ করা হয়৷ খুলনা প্লাটিনাম জুটমিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন জানান, বন্ধের সময় শ্রমিকরা বিভিন্ন পাটকলে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ এখনো খুলনার শ্রমিক পল্লীতে কান্নার রোল চলছে৷
শ্রমিকরা পাটকলের শ্রমিক কলোনিতে থাকেন৷ অনেকেরই পরিবার ও সন্তান আছে৷ সন্তানরা লেখাপড়া করছে৷ তাই তারা এখন দিশেহারা৷ তবে যারা ব্যাচেলর, তারা খুলনা ছাড়তে শুরু করেছেন৷
পাটকলগুলোতে লোকসান অব্যাহত থাকলেও শ্রমিক নেতারা মনে করেন, এর দায় শ্রমিকদের না৷ ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনার কারণেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ সময়মতো আধুনিকায়ন করা হয়নি৷ পাটের বিকল্প পণ্যের দিকে না গিয়ে শুধু বস্তা তৈরির কারণেই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ আর পাট সংগ্রহেও ভ্রান্ত নীতি এর কারণ৷
আলিম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম লিটু বলেন, ‘‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি৷ সরকারের সাথে তো যুদ্ধ করতে পারবো না৷ তবে পাটকলগুলোকে বাঁচানো সম্ভব ছিল৷ বেসরকারি পাটকল ব্যবসা করতে পারলে আমরা কেন পারবো না! তবে সেটা তো আর আমাদের ওপর নির্ভর করে না৷ আধুনিকায়নের দরকার ছিল, তা করা হয়নি৷''
পাটকল বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি নেই৷ শ্রমিক নেতাদের একদিন আগেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডেকে কোনো আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে৷ আন্দোলন করতে পারেন এরকম শ্রমিক নেতাদের আগেই ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে৷
তবে পাটকল বন্ধে একটি গ্রুপ যে আনন্দ মিছিলের আয়োজন করেছে তাতে প্রশাসন বাধা দিচ্ছে না৷ পাটকল শ্রমিক লীগের উদ্যোগে এই আনন্দ মিছিল হচ্ছে৷
বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো ঢাকা , খুলনা ও চট্টগ্রামে৷ এরমধ্যে ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে ১০টি এবং খুলনায় আটটি৷ তবে খুলানার পাটকলগুলোই বড় আকারের৷
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ১৯৯৩ সালে পাটকল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে বিএনপি সরকার যে চুক্তি করে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধ হলো৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ব করেছিলেন আর তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে সব বন্ধ হলো৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিকল্পনা দিয়েছিলাম যে, এক হাজার কোটি টাকা খরচ করলে কীভাবে পাটকল আধুনিক এবং লাভজনক করা যায়৷ কিন্তু সরকার আমাদের সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি৷ আমলাদের কথায় কাজ করেছে৷''
‘‘এই করোনার মধ্যে ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হলো৷ তারা তাদের পাওনা পাবেন৷ কিন্তু আরো ১১ হাজার বদলি এবং অস্থায়ী শ্রমিক আছেন৷ তারা বেতনের বাইরে কোনো সুবিধা পাবেন না৷ এখন সব শিল্প কারখানা সরকারের দেখানো পথে হাঁটবে৷ অনেক শ্রমিক কাজ হারাবে৷ এই অমানবিক কাজ এখন না করলেও চলতো৷ আমার মনে হয়েছে এটা শ্রমিকদের বড় অপমান,'' বললেন এই শ্রমিক নেতা৷
যুগের অবসান
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সরকার দেশের বিভিন্ন খাতের সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে৷ মিলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন কর্পোরেশন বা সংস্থাকে৷ বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)-কে পাটকলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়৷ তখন মোট ৮৭টি পাটকলকে রাষ্ট্রায়ত্ব করা হয়৷ কিন্তু পাটকলগুলো ধীরে ধীরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়৷ ক্রমাগত লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর পর ২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল৷ তারপর কয়েক ধাপে আরো পাটকল বন্ধ করা হয়৷ আর এবার সেই ধারায় ২৫টি পাটকল বন্ধ করা হলো৷ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল যুগের অবসান হলো৷
হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)