সাংবাদিকদের ধরতে নানা আইন
৮ এপ্রিল ২০২৩নির্যাতন, হয়রানি আর আইনের নানা খড়গ নিয়ে বাংলাদেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন সাংবাদিকরা৷ এর বিপরীতে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়ার কোনো আইন নেই, নেই কোনো প্রতিষ্ঠান৷
নির্ধারিত আইনের বাইরেও সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য চুরি, ডাকাতি, হত্যা ধর্ষণের মতো মিথ্যা মামলায়ও জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আর এই সব মামলা করার অভিযোগ আছে৷ তারপরও সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে শাস্তি দেয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করা হচ্ছে৷ বিবেচনায় আছে ডেটা সুরক্ষা ও ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ আইনও৷ এর বিপরীতে সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য কিছু করা হচ্ছে না৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিশানা সাংবাদিকেরা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০টি৷ ৫৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও আছে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন৷ আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হাতে ১০ জন৷ গত বছর ১২ মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোট ৪৬টি মামলা হয়েছে৷ হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২৬ জন৷ নিহত হয়েছেন ছয় জন৷
বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিনের হিসাবে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে৷ এইসব মামলায় মোট ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয়েছে আটটি৷ ২০২২ সালে মামলা হয়েছে ২৬টি৷ ২০২১ সালে ৩৫টি এবং ২০২০ সালে ৪১টি৷
২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এই মোট মামলার প্রায় অর্ধেকই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷
আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ফারুক ফয়সল বলেন, ‘‘এই সময়ে ডিজিটাল আইনের অপব্যবহার সাংবাদিকদের ওপর বেশি হচেছ৷ কিন্তু আরো অনেক আইন আছে সেগুলোও ব্যবহার হচ্ছে৷ এইজন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইনের কথা আমরা বলে আসছি৷ সেটা হলে সাংবাদিকদের ওপর যেকোনো আইনের অপব্যবহার বন্ধ হতো৷’’
আরো ২০ ধরনের আইন
হালের ডিজিটাল সিকিউরিট আইন ছাড়াও সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিতে বা হয়রানিতে ব্যবহার হয় বিভিন্ন আইন৷ এর মধ্যে আছে আদালত অবমাননা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, কপিরাইট আইন, প্রেসকাউন্সিল অ্যাক্ট, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, পোস্ট অফিস অ্যাক্ট, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, তথ্য অধিকার আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ভোক্তা অধিকার আইন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন৷ আছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা৷ এসব আইনের এক বা একাধিক ধারা ব্যবহার হয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷
এর মধ্যে আদালত অবমাননা আইনটি ১৯২৬ সালের আর অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সালের৷ রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি এর চেয়েও পুরাতন, ১৮৬০ সালের৷
ফারুক ফয়সল বলেন, ‘‘শত বছরের অনেক পুরনো আইন আছে। সেগুলো এখন আর চলে না৷ তারপরও সেগুলো সাংবাদিকদের জন্য খড়গ হিসেবে আছে৷’’
সম্প্রতি একটি সংবাদ নিয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, অন্যদেশ হলে পত্রিকাটির রেজিস্ট্রেশনই বন্ধ হয়ে যেত৷ এর প্রেক্ষিতে ফারুক ফয়সল বলেন পৃথিবীর অনেক দেশেই পত্রিকা বের করতে অনুমোদন বা রেজিস্ট্রেশন লাগে না৷ যেহেতু পত্রিকা বিজ্ঞাপন নেয় সেজন্য বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রয়োজন হয়৷
তিনি মনে করেন, সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের নিরপত্তা নিজেরা নিশ্চিত করতে পারতেন৷
সমস্যা ‘সুশাসনের অভাব’
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আইনের চেয়েও বড় সমস্যা হিসেবে দেখেন সুশাসনের অভাবকে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বড় কথা হলো আইনের শাসন ও সুশাসন৷ এটা থাকলে আইনের অপপব্যবহার হতো না৷ সেটাইতো এখানে নাই৷ আমাদের সবার উচিত এটা নিয়ে জোরেসোরে কথা বলা৷ যদি বলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হবে না বা গ্রেপ্তারের আগে অনুমতি নিতে হবে৷ তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? সাধারণ মানুষ কি হয়রানি থেকে রেহাই পাবে?''
তার মতে অনেক পুরনো আইন আছে যেগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। সেসব আইনে সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে৷ সরকারের সমালোচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়া গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না তিনি৷ ‘‘সরকারের সমালোচনা আর রাষ্ট্রদ্রোহ এক নয়৷ ভারতের আদালত কিন্তু এটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে৷ সরকারের সমালোচনায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হবে না,” বলেন এই আইনজীবী।
তিনিও মনে করেন , বিভক্তির কারণে সাংবাদিকেরা দুর্বল হচ্ছেন৷
আইনগুলো ‘আনস্মার্ট, সেকেলে’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, "আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ৩১, ৩৫ ধারা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার বন্ধ রাখতে বলেছি। কারণ এই ধারাগুলো সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ আরো অনেক আইন আছে যেগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয় সেগুলোও পরিবর্তন করতে হবে৷ বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য কাজ করছে। কিন্তু আইনগুলো আনস্মার্ট, সেকেলে। এটা তো হতে পারে না৷''
পাশাপাশি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্যই আইন করার দাবি জানান এই সাংবাদিক নেতা৷
সাংবাদিকদের বিভক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "অবশ্যই বিভক্তি আমাদের দুর্বল করে দিয়েছে৷ আমাদের নিরাপত্তা ও পেশাগত দাবি আদায়ে আমাদের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে এই বিভক্তি৷ এই কারণে সাংবাদিক নিগ্রহ বেড়েছে৷''