সাকিব, আশরাফুল এবং ভুল মানুষকে ভালোবাসা
১ নভেম্বর ২০১৯ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে দেশের ক্রিকেটাকাশের বৃহষ্পতি সাকিব আল হাসানের বিপক্ষে৷ তারই সত্যাসত্য যাচাইয়ে স্টেডিয়ামে সংবাদকর্মীদের মাছি থিকথিকে ভিড়৷
খবরটি বেরোয় সেদিন সকালের এক জাতীয় দৈনিক ‘সমকাল'-এ৷ কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে সে খবর রাষ্ট্র হয়ে যায় আগের মাঝরাত্রিতেই৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে তা৷ এরপর থেকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাদলে ৫৬ হাজার বর্গমাইল৷
সকাল ১১ টা৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তাব্যক্তিদের দেখা নেই তখনো৷ গণমাধ্যমকর্মীদের এক দল গিয়ে আসন গেড়েছে গুলশানে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসার সামনে৷ আরেক দল ক্যামেরা তাক করে হাজির সাকিবের বনানীর বাসার গেটে৷ প্রতিক্রিয়া জানতে হবে৷ জানাতে হবে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের৷ কিন্তু কোনো তরফ থেকে টু শব্দটি নেই৷
ওদিকে চলছে জাতীয় লিগের খেলা৷ বগুড়ায় বরিশাল বিভাগ-ঢাকা মেট্রোর ম্যাচটি আলাদা মনোযোগের দাবি রাখছে৷ ওখানে নাকি ফিফটি করে অপরাজিত মোহাম্মদ আশরাফুল৷ বছর কয়েক আগে এমনই ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ ওঠে যাঁর বিপক্ষে৷ প্রমাণ হয়, শাস্তিও৷ নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা সেই আশরাফুলের ব্যাট ঝলসে উঠল কিনা এমন সময়! বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টারের পর সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের একই অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হবার দিনে!
সাড়ে ১১টা৷ বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর দেখা মেলে করিডরে৷ সাকিবের অভিযোগের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেন না৷ শুধু নিশ্চিত করেন, বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো ম্যাচ ঘিরে আইসিসির অভিযোগ না৷ তাহলে কি জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ সাকিবের বিপক্ষে?
উত্তর মেলে না৷ উত্তরের খোঁজে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের ইথার বেয়ে ছুটতে থাকে সাংবাদিকদের ফোন৷ ফাঁকে মোবাইলের স্ক্রিনের স্কোরকার্ড জানিয়ে দেয়, আশরাফুল ৭১ রানে অপরাজিত থেকে গিয়েছেন লাঞ্চে৷
দুপুর ১.৪০৷ সবার জন্যই লাঞ্চের সময়৷ ঠিক তখন ক্রিকেট বোর্ডে প্রবেশ সভাপতি নাজমুল হাসানের৷ পারিষদসহ নন, একা৷ নিঃসঙ্গ তিনি নিঃশঙ্ক যে নন, সেটি থমথমে চেহারা দেখেই ঠাওর করা যায়৷
দুপুর সোয়া ২টা৷ ঢাকায় থাকা বিসিবি পরিচালকেরা একে একে আসতে থাকেন বোর্ড কার্যালয়ে৷ মাহবুব আনাম, এনায়েত হোসেন সিরাজ, খালেদ মাহমুদ সুজনরা৷ আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি আসবেন না৷ বোর্ড রাজনীতিতে কোণঠাসা এই পরিচালককে নাকি ডাকাই হয়নি৷ এ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে এক সাংবাদিকের ঘোষণা, ‘‘আশরাফুল তো সেঞ্চুরি করে ফেলেছে৷''
দুপুর পেরিয়ে বিকেল ৪টা৷ জল্পনা-কল্পনা ডানা মেলতে থাকে৷ স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝে যেখানে আটটি ক্রিকেটপিচ শোয়া, সেখানে পাখিদের ওড়াওড়ি৷ একদল চিল এসে তাড়িয়ে দেয় শালিক-চড়ুইয়ের ঝাঁক৷ আশা তাড়িয়ে প্রবল হয় যেন আশঙ্কা৷ সাকিব যে ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত, সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হতে থাকে স্পষ্ট৷
বিকেল ৫টা৷ ভেতরে ক্রিকেট কর্তাদের রুদ্ধদার বৈঠক৷ বাইরে সাংবাদিকদের ভিড় আলগা হয় না এতটুকুন৷ হঠাৎ সবাই ঝুঁকে পড়েন যাঁর যাঁর মোবাইলে; গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘সাকিবের মতো খেলোয়াড়দের সাথে জুয়াড়িরা সব সময় যোগাযোগ রাখে৷ যখনই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, সেটি আইসিসিকে সঙ্গে সঙ্গে জানানো উচিত ছিল৷ এটাকে সে গুরুত্ব দেয়নি৷ এই ভুল করেছে৷ এখন আইসিসি যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়, তাহলে আমাদের খুব বেশি কিছু করণীয় নেই৷ এখানে আমাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই৷''
সবাই যা বোঝার, বুঝে নেয়৷ শঙ্কাটাই তাহলে সত্যি৷ আইসিসি বা বিসিবির তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানোর আগেই প্রধানমন্ত্রীর এমন কথায় বোঝা যায়, সাকিব ভুল করেছেন৷ তাতে কোন শাস্তির খড়গ নেমে আসে, সেটি জানারই অপেক্ষা৷
সন্ধ্যা ৬টা৷ বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস সভা থেকে বেরিয়ে এসে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আপনারা যে জন্য অপেক্ষা করছেন, আমরাও সেজন্য অপেক্ষা করছি৷'' অর্থাৎ আইসিসি থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আগে শুনতে চায় বিসিবি৷ এরপর জানাবে নিজেদের অবস্থান৷ ততক্ষণে বগুড়া থেকে খবর আসে, আশরাফুল ১৫০ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় ইনিংস ঘোষণা করেছে তাঁর দল৷
সন্ধ্যা ৬.৩৫৷ বিষাদময় সেই বার্তা নিয়ে আসে আইসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি৷ ২০১৮ সালে দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং আইপিএলের একটি ম্যাচে সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আইসিসির কালো তালিকাভুক্ত জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের৷ এ তথ্যগুলো সংশ্লিষ্টদের জানাননি সাকিব৷ আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন৷ স্বীকার করে নেন নিজের দোষ৷ সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে নিষিদ্ধ করা হয় দুই বছরের জন্য৷ প্রথম বছরে যদি শাস্তির সময়কালীন শর্তগুলো পূরণ করেন, তাহলে এক বছর পরই ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন সাকিব৷
ফিসফাস-গুঞ্জন-কোলাহলের ১৬ ঘন্টা পর হঠাৎ যেন নিঃশব্দ হয়ে যায় ১০ দিক৷ সাকিবের নিষেধাজ্ঞার ওই বজ্রপাতে হতবিহবল বাংলাদেশ ক্রিকেট৷
সন্ধ্যা সোয়া সাতটা৷ বিসিব কার্যালয়ে দোতলায় হঠাৎ তুমুল হইচই৷ সংবাদ সম্মেলন হবে বলে৷ হল ঠিকই, তবে তাতে এলেন জাতীয় দলের কোচ রাসেল ডমিঙ্গো এবং বিসিবি পরিচালক আকরাম খান৷ ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি দিবারাত্রি করার যে প্রস্তাব এসেছে প্রতিবেশী দেশ থেকে, সেটি মেনে নেবার ঘোষণা দেন তাঁরা৷
রাত পৌনে ৮টা৷ দ্বিতীয় তলার ভিড়ের অনেকখানি নেমে এসেছে নীচে৷ স্টেডিয়ামের প্রধান গেটের বাইরে সমর্থকদের মিছিল৷ সংখ্যায় মাত্র শ'খানেক কিন্তু তাঁদের স্লোগান যেন ১৭ কোটি বাঙালির চিৎকার৷ ‘আইসিসির সিদ্ধান্ত মানি না', ‘আমরা আছি সাকিবের পাশে' এমনসব ব্যানারও তাঁদের হাতে৷ সেটি কাভার করার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের চোখ খুঁজছে সাকিবের গাড়ি৷ তাঁকে সঙ্গে নিয়েই যে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করবে বোর্ড, সেটি ততক্ষণে বিসিবির তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে অনানুষ্ঠানিকভাবে৷
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত ৮টা৷ একটা ফোন ধরার জন্য সমর্থকদের মিছিলের সামনে থেকে চলে আসি একটু ভেতরের দিকে৷ তখনই দেখতে পাই, পাশের অন্য গেট দিয়ে ঢুকে একটি সাদা রঙের গাড়ি থামল৷ বেরিয়ে আসেন সাকিব৷ পরনে সাদার উপর হালকা সবুজ স্ট্রাইপের শার্ট, নীল প্যান্ট৷ কী থমথমে মুখ তাঁর! কোনো দিকে না তাকিয়ে ঝড়ের বেগে উঠে যায় দোতলার বোর্ড কার্যালয়ে৷ ছুটে এসেও খুব বেশি ক্যামেরা পায়নি সাকিবকে৷
রাত সোয়া ৮টা৷ বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান আরো দু-একজন পরিচালক নিয়ে বেরিয়ে আসেন সাকিবকে নিয়ে৷ বিসিবির রিসেপশনের ছোট্ট সেই জায়গায় তখন অন্তত শ'দুয়েক সংবাদকর্মী৷ সাকিব তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন৷ মেনে নিলেন নিজের দোষ৷ এরপর সমর্থকদের পাশে থাকার আহবান৷ কণ্ঠে তিরতিরে কাঁপন বোঝা যায় স্পষ্ট৷ চোখের কোণের জল দেখতেও চশমা লাগে না৷ টলটলে সেই অশ্রুবিন্দু কী নিপুণ চেষ্টায় যে গড়িয়ে পড়তে দেননি সাকিব! মুখের প্রতিটি রেখার ভাঙচুরে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পন করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহাতারকা৷
বোর্ড সভাপতি তাঁর বক্তব্যে দেন সাকিবের পাশে থাকার ঘোষণা৷ সেদিকে কান খাড়া করা ছিল কিন্তু মানুষ-ক্যামেরা সবার চোখ দেখছিল শুধুই ওই চ্যাম্পিয়নকে৷ পরাজিত সাকিবকে৷ বিধ্বস্ত সাকিবকে৷ বিপর্যস্ত সাকিবকে৷
রাত সাড়ে ৮টা৷ প্রিয় স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে যান সাকিব৷ বাইরে তখনো সমর্থকদের মিছিল-স্লোগান৷ পুরো বাংলাদেশ তখনো অবিশ্বাসের ঘোরে৷ আইসিসির সাত পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের বেশ কিছু জায়গা অবশ্যই আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাব রাখে৷ ওই জুয়াড়ির সঙ্গে সাকিবের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার আদান-প্রদান, কেন তিনি সাকিবের কাছে তাঁর ডলার অ্যাকাউন্ট নম্বর চাইবেন; কেন সাকিব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন, কেন ১৩ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেও এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের তা জানাবেন না সাকিব?
তবে সব ছাপিয়ে আমার কাছে অক্টোবরের রাতে গাঢ় বিষাদময় হয়ে ওঠে আশরাফুল ও সাকিবের অভিন্ন পরিণতিতে৷ প্রথমজন বাংলাদেশের প্রথম বৈশ্বিক সুপারস্টার; পরেরজন দেশের সর্বকালের সেরা৷ হ্যাঁ, আশরাফুলের মতো ম্যাচ ফিক্সিং করে নিষিদ্ধ হননি সাকিব৷ তবে নিষেধাজ্ঞার কারণ তো এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাই৷ আর সাকিবের নিষিদ্ধ হবার দিনে জাতীয় লিগে আশরাফুলের সেঞ্চুরিতে আমার কাছে যেন আরো বেশি করে একই ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে যান এ দুজন৷
রাত ১১.১৫৷ সংবাদ প্রতিবেদন লেখার পেশাদার দায়িত্ব পালন শেষ৷ ভীষণ ক্লান্তিকর এবং তার চেয়েও ভীষণ মন খারাপ করা এক কর্মব্যস্ত দিন শেষে বেরিয়ে আসছি শেরে বাংলা স্টেডিয়াম থেকে৷ সকাল-সন্ধ্যার কোলাহল থেমে গেছে৷ জনারণ্য উধাও৷ ‘কোথাও কেউ নেই'৷ ঠিক একই নামে নব্বই দশকের জনপ্রিয় নাটকটির একটি দৃশ্য মনে পড়ছে বারবার৷ মুখোমুখি মুনা ও বাকের ভাই৷ নিজের প্রেমিক মামুনের বিয়ের খবর মুনা দিচ্ছিলেন বাকের ভাইকে৷ তা শুনে পাড়ার রংবাজ গোছের সেই মানুষটির চোখে জল৷ তা দেখে কণ্ঠে এক পৃথিবীর বিষাদ নিয়ে মুনা বলেন, ‘আমার বোধহয় আপনাকেই ভালোবাসা উচিত ছিল৷ আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি৷'
ম্যাচ ফিক্সিং সংশ্লিষ্টতায় আশরাফুল ও সাকিবের নিষিদ্ধ হবার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরও সেটি তা মনে হতে পারে৷ সত্যি, আমরা বোধহয় সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি!
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷