ডাক্তাররা লড়তে ভয় পায় না
৮ এপ্রিল ২০২০কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব জুড়ে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তাতে দেবদূত এখন স্বাস্থ্যকর্মীরাই৷ সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাণপণ করে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন৷ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে প্রাণ দিয়ে দেওয়া ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থকর্মীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷
কিন্তু বাংলাদেশে এই চিকিৎসকদের উপরই উঠছে অভিযোগের আঙুল৷ সারাদেশ থেকে বিনা চিকিৎসার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন৷ এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও মঙ্গলবার দেশে চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়েছেন৷
অন্যদিকে চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন তাদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে৷ শুরু থেকেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই আজ পরিস্থিতি এত সংকটজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক বলেন, ইটালিতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ যখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তখন সেখান থেকে আসা প্রবাসীদের কেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনে নেওয়া হলো না৷
‘‘গত ১৪ মার্চ ইতালি থেকে বড় যে দলটি এসেছিল প্রথমে বলা হলো তাদের প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টিনে নেওয়া হবে৷ তারপর তাদের কেন চলে যেত দেওয়া হলো৷ করোনা ভাইরাস যখন বিশ্বজুড়ে ছড়াতে শুরু করে তখন বিদেশ থেকে আসা সবার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টিন বাধ্যতামূলক করা হলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারতো না৷ এটা কার দায়িত্ব ছিল৷’’
আরেক চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘চীন থেকে ভাইরাসের বিস্তার শুরুর পরপর চিকিৎসকদের নানা সংগঠন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আশংকা কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের আবেদন জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেন নাই৷
‘‘কেন আমাদের পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) চাইতে হলো৷ সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের বলা হয় ‘সুপার স্প্রেডার’৷ কারণ অসুস্থ হলে মানুষ ডাক্তারের কাছেই আসেন৷ ডাক্তারের সুরক্ষা না থাকলে তার মাধ্যমে তার কাছে আসা বাকি রোগীরা সংক্রমিত হবেন৷ ওই রোগীরা বাসায় গিয়ে যার যার পরিবারকে সংক্রমিত করবেন৷ বুঝতে পারছেন তখন কী হবে৷ আমাদের জন্য তো পিপিই ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার আদেশ জারি হয়েছিল৷ যদিও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়৷’’
না জেনে করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে টোলারবাগে দুই জন চিকিৎসক সংক্রমিত হয়েছেন৷ এছাড়া করোনা আক্রান্ত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের অবস্থা সংকটজনক হওয়ায় বুধবার তাকে ঢাকায় নিয়া যাওয়া হয়েছে বলা জানায় প্রথম আলো৷ আরো কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স করোনা আক্রান্ত হয়েছেন৷
করোনা আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেওয়া একাধিক হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের আইসোলেশন বা হোম কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়েছে৷
এভাবে যদি সব চিকিৎসাকর্মীরা আক্রান্ত হন বা আইসোলেশনে যান বা হোম কোয়ারান্টিনে চলে যান তবে কে চিকিৎসা সেবা দেবেন, কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন আরেক চিকিৎসকের৷
সুরক্ষা উপকরণ দাবি করা নিয়ে দ্বন্দের জেরে রাজধানীর আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷ যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ওই চিকিৎসকরা নিজেরাই আসছেন না৷
ঢাকার যে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে অতি সংক্রামক এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তার একটি ধানমণ্ডির এই হাসপাতাল৷ ‘চাকরিচ্যুত’ চিকিৎসকরা বলছেন, ওই রোগীর মৃত্যুর আগেই তাদের এখানে আসা কয়েকজন রোগীর মধ্যে ‘করোনা ভাইরাসের উপসর্গ’ দেখতে পান তারা৷ কনসালট্যান্টরাও তাদের বিষয়ে একই অভিমত দেন৷ তখন থেকেই পিপিই চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি৷
গত মাসের শেষ দিকে হাসপাতালের আইসিইউতে করোনা আক্রন্ত এক রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসকদের জোরাল দাবির মুখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুরক্ষা উপকরণ দিলেও তা জুনিয়র চিকিৎসকরা পাচ্ছিলেন না৷
‘করোনা ফেসবুক অ্যাওয়ারনেস গ্রুপ’ নামে একটি পাতায় মোশাররফ হোসেন মুক্ত নামে একজনের পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে৷ যেখানে তিনি জানান, তার মেয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের একজন চিকিৎসক৷ যিনি দায়িত্বরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়ে সি এম এইচে সিসিইউতে ভর্তি আছেন৷ ‘‘সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন৷ ওর অটিস্টিক ছেলে আর মেয়ে ওর অপেক্ষায় আছে৷’’
আব্দুর রহিম নামে আরেক চিকিৎসকের পোস্ট: ‘‘শুক্রবার, ভোর ৪টা৷ ডা. মোস্তাফিজ এবং আমি ঢাকা শহরের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে রেফার্ড করা রোগী দেখতে রাউন্ডে যাচ্ছি৷ সবাই মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেন৷’’
চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন না এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমি সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার৷ নিজের অভিজ্ঞতাই বলি৷ সম্প্রতি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত এক শিশুকে নিয়ে তার বাবা হাসপাতালে আসলে তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে চাই৷ কিন্তু ওই ব্যক্তি রাজি হন নাই৷ পরীক্ষা ছাড়াতো আমি নিশ্চিত হতে পারছি না শিশুটি করোনা আক্রান্ত কিনা৷ তাই কিছু বলতেও পারিনি৷ শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তি ছেলেকে নিয়ে চলে যান৷
‘‘অবহেলার ঘটনা একেবারে নেই সেটা বলছি না৷ কিন্তু বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা দিয়ে আপনি গণহারে ডাক্তাদের দোষ দিচ্ছেন এটা ঠিক না৷ আমাদের এখন প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে৷ শারীরিক পরিশ্রমও বেড়েছে৷ দয়া করে চাপ আর বাড়াবেন না৷ আমরাও মানুষ৷ আমাদের সহ্যেরও সীমা আছে৷’’
হাতে পাওয়া পিপিই নিয়েও ডাক্তারদের ক্ষোভ রয়েছে৷ অনেকে বলছেন, এগুলো রেইন কোর্ট বলা বরং ভালো৷ ভাইরাস সংক্রমণ আটকাতে কতটা সক্ষম তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷
বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বেতন না পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন৷
এসএনএল/কেএম