বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের দুই চ্যালেঞ্জ
১৯ ডিসেম্বর ২০২১বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে যেমন সাফল্য আছে তেমনি কিছু দুর্বলতাও দেখছেন অর্থনীতিবিদরা৷ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা৷ আয় বৈষম্য কমানো, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আয়ের বহুমুখী খাত তৈরি এরমধ্যে অন্যতম৷ পাশাপাশি দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধ এবং সুশাসন নিশ্চিতের উপরও জোর দিচ্ছেন তারা৷
সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৫৫৪ ডলার, যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি৷ ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি৷ এমনকি ভারতকেও পিছনে ফেলার পথে৷ করোনার ধাক্কায় বিশ্বের অনেক দেশের জিডিপি যেখানে কমেছে সেখানে বাংলাদেশের উলটো প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ সবগুলো শর্ত পূরণ করে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকেও বেরুনোর স্বীকৃতি মিলেছে চলতি বছর৷
বাড়ছে আয় বৈষম্য
প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ওয়ার্ল্ড ইকুয়্যালিটি ল্যাবের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক শতাংশ বিত্তশালীর হাতে মোট আয়ের ১৬ দশমিক তিন শতাংশ৷ মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে এখন নতুন করে কোটিপতি হচ্ছেন পাঁচ হাজার৷
অথচ বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, করোনার পরে ব্যাপক সংখ্যায় দারিদ্র্য বেড়েছে৷ ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার(পিপিআরসি) পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষা বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে নতুন করে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷ গত মার্চেও এই সংখ্যা ছিলো দুই কোটি ৪৫ লাখ৷ অর্থাৎ, ছয় মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৭৯ লাখ মানুষ৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ২০ লাখ মানুষ তীব্র ও মাঝারি খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন৷ দুই বছরে খাদ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষ বেড়েছে ১২ লাখ৷
অন্যদিকে দুইদিন আগে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়৷ ঘুস বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ট্রেস’ বলছে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঘুসের ঝুঁকিতে আছে৷
‘উন্নয়ন কতিপয় খাতভিত্তিক’
জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্র উঠে আসে দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে৷ রোববার সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে৷ সংস্থাটির বলছে চলতি অর্থবছরে ছয় দশমিক ছয় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা তাদের অক্টোবরের পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি৷
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে অব্যাহত বিনিয়োগের ইতিবাচক প্রভাব আমরা অর্থনীতিতে দেখতে পাচ্ছি৷ এই যে অর্থনেতিক উন্নয়ন তা কতিপয় খাতকেন্দ্রিক৷ আমাদের অগ্রগতি পোশাক শিল্প ও প্রবাসী আয় নির্ভর৷ কিন্তু এটাকে বহুমুখী খাত ভিত্তিক করা প্রয়োজন৷ তা না হলে এক সময় এই উন্নয়ন ভঙ্গুর হতে পারে৷ মানুষের কর্মসংস্থান না হলে আয় বৈষম্য বাড়ে এবং তাই হচ্ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে আয় বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি সেটা যেন কতিপয় ব্যবসায়ী নির্ভর না হয়৷ খাদ্য নিরাপত্তা শুধু খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানির ওপর নির্ভর করে না৷ সাধারণ মানুষ কতটুকু পুষ্টি পাচ্ছে তা জরুরি৷ উচ্চ মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের তা নাগালের বাইরে থাকত পারে৷’’
তার মতে দুর্নীতি প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে৷ নাগরিকরা তাদের প্রাপ্য সুযোগ থেকেও একারণে বঞ্চিত হন৷ ‘‘অর্থ পাচার দেশের উন্নয়নকে পিছিয়ে দেয়৷ এটা বন্ধ হলে গতি আরো বাড়ত,” বলেন তিনি৷
‘প্রাপ্য সুফল তারা পাচ্ছেন না’
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন প্রকৃত উন্নয়ন কেমন হওয়া উচিত তা দেখিয়ে দিয়েছে কোভিড মহামারি৷ তিনি বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি একদিকে বৈষম্য বাড়ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি দিতে মানুষ সমূদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে৷ এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে৷ আর সেখানে থাকতে হবে অধিকাংশের উন্নয়ন পরিকল্পনা৷ গ্রাম আর শহরের সম উন্নয়ন৷’’
তার মতে, ‘‘অধিকাংশের উন্নয়ন নির্ভর করে অধিকাংশের অংশগ্রহণের সুযোগের উপর৷ আর তার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক বাস্তবতা, জবাবদিহিতা এবং রাষ্ট্রকে নাগরিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠা৷”
বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের উন্নয়নের জন্য অভিবাসী ও শিল্প শ্রমিকদের কৃতিত্ব দেন ড. তিতুমীর৷ কিন্তু এর প্রাপ্য সুফল তারা পাচ্ছেন না বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘এরজন্য দরকার সুশাসন৷ সেটা না হলে রাষ্ট্র নাগরিকের রাষ্ট্র হবে না৷ উন্নয়নও সবার জন্য হবে না৷ আর সেটাকে ঠিক উন্নয়ন বলা যায় না,’’ বলেন তিনি৷