সেরার তালিকায় থেকেও 'উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান' নয় যাদবপুর
১৫ জুন ২০২৩'ইনস্টিটিউট অফ এমিনেন্স' অর্থাৎ উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রের শিক্ষা মন্ত্রক দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই শিরোপা দেয়। এর সঙ্গে দেয়া হয় আর্থিক সাহায্য। যোগ্যতার মাপকাঠিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ হলেও বাজেট সংক্রান্ত সমস্যায় তার শিরোপা প্রাপ্তি আটকে গিয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে উৎকর্ষের নিরিখে তালিকাভুক্ত করে। এ বছরের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে যাদবপুর। এক নম্বরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। দ্বিতীয় স্থানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া।
এই তিনটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে কলকাতার প্রথম সারির এই প্রতিষ্ঠান। দ্বাদশ স্থানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী রয়েছে অনেক পিছিয়ে ৯৭ নম্বরে।
২০১৮ সালে যাদবপুর কে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রক। সেই সময় হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার কথা ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। শর্ত অনুযায়ী এর ২৫ শতাংশ টাকা দিতে হতো রাজ্য সরকারকে।
এই ব্যয়ভার বহন করতে না পারার কথা রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয় কেন্দ্রকে। প্যাকেজ কমানোর সুপারিশও করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শেষমেষ যাদবপুরকে এই তালিকা থেকে বাদ রাখে।
গুণগত বিচারে যাদবপুর প্রথম সারিতে থাকায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মন্ত্রকের কাছে আবেদন করেন, যাতে তাদের উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা রাখা হয়। সেক্ষেত্রে বড় অঙ্কের আর্থিক অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রক রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, যাদবপুরকে এই তালিকায় রাখা যাচ্ছে না।
এর ফলে অনুদান থেকে বঞ্চিত হবে আর্থিক সঙ্কটে থাকা যাদবপুর। অনুদানের টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের মেরামতি ও নির্মাণ, গবেষণা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া গবেষণা প্রকল্প অব্যাহত রাখতে এবং গবেষকদের ভাতা দিতেও বড় অঙ্কের বরাদ্দ দরকার। অতীতে কেন্দ্র ও রাজ্যের ঘোষিত বরাদ্দেরও পুরোটা মেলেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। তার বক্তব্য, "যাদবপুরকে উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা না দেওয়ার জন্য কুযুক্তি দেয়া হচ্ছে। অথচ যে বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তৈরি হয়নি, সেটি জায়গা পেয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রের তালিকায়।"
একই সুরযাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক তরুণ নস্করের মুখে। সাবেক বিধায়ক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জিও ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস খোলেনি, তাকে হাজার কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। তা হলে যাদবপুর কেন পাবে না? আদতে এটা শিক্ষার বেসরকারিকরণের একটা ধাপ।"
রাজ্য সরকার বেতন খাতে অর্থ দিলেও বাকি বিপুল ব্যয় সামলাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্র ও রাজ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সমস্যা কিছুটা সমাধানে যাদবপুরের সাবেক উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই সাহায্যে কি প্রথম শ্রেণির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ বছরের পর বছর ধরে রাখা সম্ভব?
যাদবপুরের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অনুদান ছাড়া উৎকর্ষ ধরে রাখা সম্ভব নয়। টাকা না পেলে গবেষণা এগোবে কী করে? এছাড়া পঠনপাঠনের উন্নতি, বৃত্তি দেয়া অসম্ভব হবে। সমস্যা হচ্ছে, এটা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ততটা ভাবিত নয়।"
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যাদবপুরের রসায়নের অধ্যাপক, কার্টুন বিতর্কে একসময়ে গ্রেপ্তার হওয়া অম্বিকেশ মহাপাত্র। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শিক্ষা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নইলে মাসের পর মাস স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয় না? এখন আবার উপাচার্যের বেতন বন্ধের ফতোয়া দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। এটা কি উৎকর্ষ রক্ষার অনুকূল পরিবেশ?"
যাদবপুরের বঞ্চনার নেপথ্যে রাজনীতির সংঘাতকে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ। রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপাল তথা আচার্য সিভি আনন্দ বোসের বিরোধ এখন চরমে। স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে জটিলতা ক্রমশ বাড়ছে। যাদবপুরের প্রাক্তনী, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদের মধ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই, তার ছায়া সব ক্ষেত্রে পড়ছে। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও একই বিষয় হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। এটা যদি হয় তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।"