সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী
২৫ মে ২০১৬এমনটিই জানাচ্ছে সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যম৷ কিন্তু বাংলাদেশের জনশক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, ভিন্ন কথা৷ তাঁদের মতে, সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা নির্যাতন, এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন৷
সৌদি আরব এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০ হাজারের মতো নারী গৃহকর্মী নিয়েছে৷ সে দেশের একটি নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হুসেইন আল-হারথি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন, ‘‘এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ বা ৪০ হাজার নারী গৃহকর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷''
হারথি দাবি করেন, ‘‘বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কাজে অস্বীকৃতি, বাংলাদেশে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং সৌদি আরবের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পার৷''
বিভিন্ন নিয়োগকারী অফিসের মালিকরা জানান, ‘‘একজন গৃহকর্মীকে যাচাই করার জন্য গ্রাহকরা তিন মাস সময় পান৷ আর এ সময়ের মধ্যে সে গৃহকর্মী যদি অদক্ষ বলে বিবেচিত হন, তাহলে তারা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বরাবর সে তথ্য জানান এবং গৃহকর্মীকে ফেরত দেন৷ পাশাপাশি গৃহকর্মীর অযোগ্যতার কারণ জানিয়ে দূতাবাস বরাবর নোটিশও পাঠানো হয়৷ এরপর নিয়োগকারী অফিস থেকে গৃহকর্মীদের নিজ নিজ দূতাবাসে হস্তান্তর করা হয়৷ আর তখনই দূতাবাসে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়৷''
আলি আল-ওমারি নামে আরেক নিয়োগকারী অফিসের মালিক জানান, ‘‘নারী গৃহকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে দেড় লাখ ভিসা ইস্যু করা হয়েছে৷ তবে ভিসার বিপরীতে সবাই সৌদি আরবে যাননি৷''
সৌদি আরবে বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের সূত্র উদ্ধৃত করে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ‘‘সৌদি আরবে পাঠানোর আগে গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে বাংলাদেশ সরকার প্রশিক্ষন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কেননা, টাকা উপার্জনই বর্তমান বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''
এদিকে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, ‘‘বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের কাজে অনীহার কারণ ভিন্ন৷ তাঁরা নির্যাতনের শিকার এবং তাঁদের বেতনও খুব কম দেয়া হয়৷ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসে ১৫০ জন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবের কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছেন৷ সে সময় রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তিনটি কারণে নারী গৃহকর্মীরা তাদের কাজ ছেড়ে পালাচ্ছেন৷ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে – গৃহকর্মীদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো, গৃহকর্মীদের নিজের বাড়ির প্রতি দুর্বলতা থাকা এবং গৃহকর্তার কাছ থেকে নানা দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া৷
কেবল বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরাই নয়, সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ অন্য দেশগুলোও করেছে৷ গত বছর সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীর ওপর যৌন নির্যাতনের একটি খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নিন্দার ঝড় তুলেছিল৷ সেবার গৃহকর্মীর ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন এক সৌদি নাগরিক৷ স্বামীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই নারী ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন৷
একই বছর এক ভারতীয় গৃহকর্মী তার কাজ থেকে মুক্তি চাইলে গৃহকর্তা তার ওপর হামলে পড়েন৷ কেবল তাই নয়, ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহকর্তা একটি ছুরি দিয়ে ওই গৃহকর্মীর হাত কেটে ফেলেন৷
বাংলাদেশের জনশক্তি বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু শারীরিক নয়, বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ওপরও যৌন নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে৷ নির্যাতিতরা নানা কারণে তা প্রকাশ করেন না৷ তাদের সঙ্গে দাসের মতো আচরণ করার অভিযোগও আমরা পাই৷''
কিরন বলেন, ‘‘এই কারণে ফিলিপাইনস, শ্রীলঙ্কা সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেছে৷ আমাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে৷ বাংলাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি রহস্যজনক কারণে আমলে নিচ্ছে না৷''
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ আরো বলেন, ‘‘মজুরিতে বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ঠকানো হয়৷ যে মজুরির কথা বলা হয় তা দেয়া হয় না৷ তাঁরা সৌদি আরবে যা আয় করেন, তা এখন বাংলাদেশে বসেই আয় করা সম্ভব৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের দ্রুত এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে করণীয় ঠিক করা উচিত৷ যদি সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠাতেই হয় তাহলে তা সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) ভিত্তিতে নয়, সুনির্দিষ্ট চুক্তির অধীনে পাঠানো উচিত, যে চুক্তিতে বেতন, ক্ষতিপূরণ এ সব আইনগত অধিকারের বিসয়গুলো সুনির্দিষ্ট থাকবে৷''
প্রসঙ্গত, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১ লাথ ২০ হাজার নারী গৃহকর্মী নেয়ার সমঝোতা স্মারক সই করে৷ তবে আট বছর ধরে দেশটি বাংলাদেশ থেকে পুরুষ শ্রমিক নেয়া বন্ধ রেখেছে৷