সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল?
৩০ আগস্ট ২০১৯বাংলাদেশে নয় কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেটে সংযুক্ত৷ আর তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বলা হয়ে থাকে পাঁচ কোটির মত৷ আর এই ফেসবুকও বেশি ব্যবহার হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে৷
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের কানেকশন(সিম) এখন ১৬ কোটির বেশি৷ তবে ব্যক্তি হিসেবে এই সংখ্যা কম হবে৷ আর স্মার্ট ফোন সেটের সংখ্যা মোট ফোনের প্রায় ৫০ ভাগ৷ বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তাদের ওয়েব সাইট থেকে এসব তথ্য জানা যায়৷
এখন মোবাইল ফোন থেকেই ছবি বা ভিডিও করে সরাসরি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা যায়৷ আপ করা যায় টেক্সট৷ আর এই সুবিধার কারণে ব্যক্তিই হয়ে উঠছেন একজন স্বাধীন ব্রডকাস্টার৷
সিলেটের শিশু রাজন, ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতের ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই৷ নিরাপদ সড়কের জন্য সামাজিক আন্দোলন অথবা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেইর ফল৷
এর বিপরীত চিত্রও আছে৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে এখন যেসব অপরাধের অভিযাগে আসে তা প্রধানত ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংক্রান্ত৷ এই ইউনিটের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া জানান,‘‘আমরা বেশি অভিযোগ পাই মানহানি, প্রতারণা এবং অপপ্রচারের৷ হেয় করার প্রবণতাই বেশি৷ বিশেষ করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও এবং ছবি দিয়ে মানহানি করা হয় বেশি৷'' প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন সরাসরি হাজির হয়ে অভিযোগ করেন৷ আর সব মিলিয়ে গড়ে ৩০টি অভিযোগ পায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট৷ মাসে এক হাজারের মত৷ আর এই ধরনের অপরাধের বেশি শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
বরগুনার আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির কথাই ধরুন৷ তার স্বামী হত্যার ঘটনাটি নিয়ে এত আলোচনা ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার কারণেই৷ আবার এখন মিন্নিকে তার ‘স্বামী হত্যায় দায়ী করে' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই যেন বিচার করা হচ্ছে৷ আর প্রিয়া সাহার বক্তব্যের জন্য শুধু তাকেই নয়, তার স্বামী এবং পরিবারের সদ্যদেরও ‘বিচার' করে ফেলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর বড় একটি অংশ৷
তবে সোশ্যাল মিডিয়া এ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক মনে করেন,‘‘এটাকে সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল বলা যাবেনা৷ কারণ এর মাধ্যমে আসলে বিচার হচ্ছে না৷ চূড়ান্ত বিচারে সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ ভূমিকাও রাখেনা৷ এর মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ পড়ে প্রশাসনের ওপর চাপ পড়ে নজর দেয়ার জন্য৷'' তিনি মিন্নির ঘটনাকে এক্ষেত্রে একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ বলে মনে করেন৷ তার মতে,‘‘মিন্নির পক্ষে সামাজিক মাধ্যমের প্রবল চাপ থাকলেও পুলিশ কিন্তু তাকে আটক করেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল হলে কিন্তু তাকে আটক করার কথা নয়৷''
মূলধারার গণমাধ্যম অনেক সময়ই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনুসারী হচ্ছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হওয়ার পর মূল ধারার গণমাধ্যম সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. শামীম রেজা মনে করেন,‘‘মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের একটা নীতিমালা আছে৷ তাদের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ আছে৷ তারা জানেন একজনের ব্যক্তিগত বিষয়ে কতটুকু যাওয়া যাবে৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের সেই প্রশিক্ষণ সবার নেই৷ ফলে নাগরিক অধিকার খর্ব হয়৷ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়৷ আবার এটা গণতন্ত্রের জন্য যেমন ব্যবহার হয়, গণতন্ত্রবিরোধীরাওতো ব্যবহার করেন৷''
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা জাজমেন্টাল হন কখনো কখনো৷ এমনকি ভুল অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়েও প্রচার প্রোপাগান্ডা চালানো হয়৷ কাউকে লেভেল করে দেয়ার অভিযোগও আছে৷ ইউনিভর্সিটি অব লিবারেল আর্টস-এর মিডিয়া স্ট্যাডিজ ও জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন,‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কখনো আমাদের সঠিক বার্তা দেয়৷ আবার কখনো জাজমেন্টাল৷ প্রযুক্তির বিকাশের কারণে আমি এখন এই মিডিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ কারণ এটা ব্যক্তির অধিকার ও গোপনীয়তার ওপর আঘাত করছে৷''
আর আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন মনে করেন,‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সমস্যা দূর করতে হবে ব্যবহারকারীদেরই৷ ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীল হতে হবে৷ সরকারকে সুযোগ দেয়া যাবে না৷ বাংলাদেশের মত দেশে সরকার চায় এটা নিয়ন্ত্রণ করতে৷ কারণ মানুষ এখন এখানেই মুক্তভাবে কথা বলতে পারে৷ মত প্রকাশ করেন৷''
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷