‘সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তরুণরা অলস হচ্ছে’
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ডয়চে ভেলে: তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে কেন?
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা ছোটবেলায় মাঠে যেতাম৷ এখন মাঠ নেই৷ শিশুরা ঘরে থাকে৷ এখন তাদের বিনোদনের মাধ্যম বলতে সোশ্যাল মিডিয়া৷ সেখানে তারা চ্যাট করছে, আড্ডা দিচ্ছে৷ এর ফলে ব্যক্তি যোগাযোগ ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ এর কিছু ভালো দিক আছে৷ যেমন এবারের বইমেলায় আমার চারটি বই বের হয়েছে৷ সেটা আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দিলাম, আমার পাঁচ হাজার বন্ধু সেটা দেখল, তারা বইটা নিয়ে সমালোচনা করল, আলোচনা করল, তাতে আমি সমৃদ্ধ হলাম৷ তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আবেগের চাপ থাকলে সেটা একটু রিলিজ করে৷ আর অপজিট সেক্সের প্রতি দুর্বলতা আমাদের সহজাত প্রবণতা৷
এই সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সহজেই মেয়েবন্ধু পাওয়া যায়, ছেলেবন্ধু পাওয়া যায়৷ এই যোগাযোগের কারণে মানুষের আবেগ একটা জায়গায় আবদ্ধ থাকছে না৷ চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে৷ এই সম্পর্ক ব্যক্তি জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে৷ আরো ভালো উদাহরণও আছে৷ এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের তৈরি হয়েছিল৷
সব জায়গায় খারাপ গ্রুপ আছে, এখানেও আছে৷ ওই গ্রুপগুলো মেয়েদের টার্গেট করে, গৃহবধুদের টার্গেট করে৷ দীর্ঘদিন ধরে একটা সম্পর্ক তৈরি করে, এরপর তারা অনৈতিক সম্পর্ক করে এবং সেটা ভিডিও করে পরে ব্ল্যাকমেল করছে৷ এমন একজন নারী আমার কাছে এসেছিলেন তিনি ওই খপ্পরে পড়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টটিও তাদের লিখে দিয়েছিলেন৷ তাতেও নিষ্কৃতি পাননি৷ পরে তিনি মানষিক রোগী হয়ে যান৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে তরুণরা আগ্রহী হচ্ছে তার পেছনে কিসের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি?
আমরা সবাই কিন্তু নিজের কথাটা অন্যের কাছে বলতে চাই৷ এই শেয়ার করার প্রবণতা আগেও ছিল৷ আগে হয়ত এটা বন্ধু-বান্ধবের কাছে বলত৷ এখন সেটা সে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে৷ সেটা দেখে অনেকে কমেন্ট করছে, অনেক রকম মন্তব্য হচ্ছে৷ সবার হাতেই যেহেতু এখন স্মার্টফোন আছে, সেই ফোনের ব্যবহার এক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে৷ মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার কারণে আমাদের অনুভূতি যুগে যুগে যেটা ছিল, সেটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তরুণরা কি উপকার পাচ্ছে? এর ক্ষতিকর প্রভাবটা কী?
হ্যাঁ, অবশ্যই উপকার পাচ্ছে৷ এখানে যারা বই পড়ে, তাদের একটা গ্রুপ আছে৷ ওই বইগুলোতে কী আছে সেগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করছে৷ আমি নিজেও এই ধরনের গ্রুপে ঢুকে ওদের আলোচনাগুলো দেখি৷ ওরা এমন সব বই পড়েছে যে বইগুলো দুর্লভ৷ আমি তাদের আলোচনা দেখে সমৃদ্ধ হই৷ আবার এর খারাপ প্রভাবও আছে, কারণ, তরুণরা এমন সব ওয়েবে ঢুকে যাচ্ছে, সেখানে পেশাদার নারী-পুরুষের রঙ্গলীলা তারা দেখছে৷ এতে করে তাদের বাস্তব জৈবিক চাহিদা বিকৃত হচ্ছে৷ আমি তো বলব এইসব সাইটে ঢুকে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ক্ষতিটা হচ্ছে বেশি৷ কারণ এ সব দেখার কারণে একটা মেয়ের স্বাভাবিক পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময় ১৩ থেকে ১৫ বছর, এখন সেটা ৮ থেকে ৯ বছরেই হয়ে যাচ্ছে৷ এতে করে তার মধ্যে একটা যৌন চাহিদা তৈরি হচ্ছে৷ তখন সে হয়ত খারাপ খপ্পরে পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে যাচ্ছে৷
আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া কি তরুণ সমাজের মনকে তুষ্ট করতে পারছে?
সোশ্যাল মিডিয়ার সবই যে খারাপ তা তো নয়৷ এখানে ভালো-খারাপ দু'টোই আছে৷ তবে সবচেয়ে খারাপ যেটা, সেটা হলো, আমাদের তরুণরা অলস হয়ে যাচ্ছে৷ তাদের শরীরের কর্মক্ষমতা অনেক কমে যাচ্ছে৷ তাদের উল্লাস করার ক্ষমতা বা হইচই করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ তাদের মানসিক শক্তি কমে যাচ্ছে৷ যখনই তারা কোনো স্ট্রেসে পড়ে, সেটা থেকে উঠতে পারে না৷ আমরা যখন ছোটবেলায় মাঠে খেলতে গেছি, তখন হেরে গেলে সেটা সহ্য করার শক্তি অর্জন করেছি, আবার জিতে গেলে সেটা ধারণ করার শক্তিও অর্জন করেছি৷ এখন যেটা হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেট দল হেরে গেলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভয়ংকরভাবে গালিগালাজ করা হচ্ছে৷ আবার জিতে গেলে রাস্তায় মিছিল নিয়ে বের হচ্ছে৷ মানে, এই হার-জিতের মধ্যে কোনো ভারসাম্য নেই৷ বিশেষ করে পরাজয় বরণ করার মতো কোনো শক্তিই তাদের মধ্যে নেই৷ খেলাধুলার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকে হার-জিতের শক্তি সঞ্চিত হয়৷ এই সঞ্চয় তরুণ প্রজন্মের কম হচ্ছে৷ এতে করে তারা যে কোনো ছোটখাটো বিপর্যয়েও ভেঙে পড়ছে৷
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের আগে ও পরে কী ধরনের পার্থক্য দেখা যায়?
সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা যখন বসে, তখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা সেটা ব্যবহার করছে৷ এমনকি রাত জেগে তারা এটা ব্যবহার করছে৷ যখন তারা রাত জাগে, তখন পরের দিন সকালে স্কুলে বা কলেজে যেতে চায় না৷ এতে তাদের রেজাল্ট খারাপ হয়৷ বাবা-মা চাপ দেয়৷ তখন তারা মানসিক রোগী হয়ে যায়, আর আমাদের কাছে আসে৷ আমরা ছোটবেলায় যখন পড়তাম, তখন শুধুই পড়াশোনা করতাম৷ যখন খেলতে যেতাম, তখন খেলাধুলা করতাম৷ আর এখন তারা খেলাধুলা করে না, সারাদিন সারারাত এটার মধ্যেই বসে থাকে৷ এতে তাদের শারীরিক সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে৷ তাদের ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না৷ কিন্তু ব্রেনকে রাতে ঘুমাতে দিতে হবে৷ আপনি যদি ঠিকমতো না ঘুমানো, তাহলে আপনার ব্রেন ঠিক মতো কাজ করবে না৷ চাপে থাকবে৷ আপনার প্রোডাক্টটিভিটি কমে যাবে৷ আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যহত হবে৷
আমাদের তরুণদের একটা অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা কতখানি?
শুধু যে অপরাধে জড়াচ্ছে, তা নয়, আবার অপরাধের বিরুদ্ধেও তারা সোচ্চার হচ্ছে৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, এই কারণে নারীর প্রতি বা পুরুষের প্রতি আমাদের তরুণদের শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে৷ একজন আরেকজনকে ছোট করে মতামত দিচ্ছে৷ তাদের মধ্যে ভোগবাদী অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে৷ এখানে ভোগবাদী অস্তিত্বের চেয়ে মমতা বা ভালোবাসার জায়গান থাকতে হবে৷ আমাদের তরুণদের মধ্যে বন্ধন দুর্বল হচ্ছে৷ তারা নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে৷ এর ফলে তারা যে কোনো ধরনের অপরাধে যুক্ত হচ্ছে, কিন্তু তারা সেটি বুঝতে পারে না৷
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর দিক থেকে বের হয়ে আসার পথগুলো কী কী?
আমাদের টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন৷ আমি বলব, আমরা যদি আমাদের আকাশসীমাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে৷ ভালো জিনিসই শুধু আমরা ঢুকতে দেব, খারাপগুলো ঢুকতে দেব না৷ তাহলে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে যাবে৷ বাজে ওয়েবসাইট ঢুকতে দেব না৷ কিছু নিয়মনীতি যদি থাকে, মিডিয়াতে অন্যকে অপদস্থ করা যাবে না৷ কেউ কিছু করলে তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ কিন্তু হুট করেই সামাজিক যোগাযোগে কিছু বলা যাবে না৷ যেমন ধরুন, রাজন হত্যার বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই জনমত গড়ে উঠেছে৷ খারাপ জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় থাকবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন মন্তব্যে৷