স্কুলে গণতন্ত্র চর্চা থেকে আমি যা শিখেছি
১৬ এপ্রিল ২০১৯বাবা-মা সরকারি চাকুরে হলে এক জীবনে বেশ কয়েক রকম স্কুলে পড়ার (সৌ)ভাগ্য হয় ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের৷ চাকরিসূত্রে একাধিক শহরে বাসা বাঁধতে হয় যে বাবা-মায়েদের, তাদের সন্তানরাই বুঝবে ঠিক কতটুকু আলাদা হয় দুই শহরের স্কুলের ধরন৷ আমিও কোনো ব্যতিক্রম ছিলাম না৷
আসামের ছোট শহর শিলচরে ক্লাস এইট পর্যন্ত যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে ‘স্কুল ক্যাপ্টেন' হওয়ার মুরোদ বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার ছিলনা৷ তখন আমি ব্যস্ত থাকতাম কীভাবে সবক'টা গান-নাচের অনুষ্ঠানে একটু হলেও মুখ দেখানোর সুযোগ পাওয়া যায়, সেই ছুতোয়৷
কিন্তু ছোট শহর হলে যা হয়, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমার বাবা-মাকে চেনেন৷ কেউ কেউ আবার আমার দাদুর ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন কলেজে৷ সুতরাং আমাকে ‘ক্লাস ক্যাপ্টেন' বানিয়ে দিলে ‘নেপোটিজম'-এর ধারা অব্যাহত থাকে৷ কেউ আমার বেচারি সহপাঠীদের মতামত নেবার প্রয়োজনটুকুও বোধ করলেন না৷ হয়ে গেলাম কয়েক মাসের জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন৷ তার ফলে যা হলো, হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতার জেরে আমি বদলে যেতে লাগলাম৷ ফাঁক পেলেই কীভাবে কোনো বন্ধুর ব্যাগের ভেতর লুকোনো চুইংগাম ধরিয়ে দিয়ে ‘সেরা ক্লাস ক্যাপ্টেন' হওয়া যায়, সেই তালে থাকতাম৷ একবার তো ক্লাস ফোরে পড়া আমার নেতৃত্বেই ক্লাস টেনের দুই দাদা'র ‘পেরেন্টস কল' হয়েছিল৷ তাদের দোষ স্কুলের সময় বাথরুমের পেছনে লুকিয়ে ওয়াকম্যানে গান শোনা৷ আমি তখন ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর৷ আমি তখন মনে মনে অপরাজেয়৷
যাই হোক, গঙ্গা-পদ্মা-বরাক নদী দিয়ে অনেক জল গড়ালো আর আমিও রীতিমত ‘ডানা' ভেঙে শিলচর থেকে কলকাতায় এসে পড়লাম৷ মফস্বলের ‘নেত্রী' আমার কপালে জুটল নাক-উঁচু মেয়েদের কনভেন্ট স্কুল৷ যেখানে ফড়ফড়িয়ে ইংরেজির বন্যা ছোটানো মেয়েরা আমার সিলেটি উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা করে মজাই পেত৷ ছোট শহরের বড় নেত্রী বড় শহরে এসে বেমালুম চুপ মেরে গেল৷ এমনই চলছিল সবকিছু, কিন্তু ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় গণতন্ত্রের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো অবশেষে৷
আমাদের স্কুল কলকাতায় বিখ্যাত ছিল বার্ষিক ‘ফেস্ট' বা সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য৷ সেই উৎসবের মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন বাংলা চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতের একাধিক তারকা৷ অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের মতো নামকরা ব্যক্তিত্বদের সবার শুরু এই স্কুলের ফেস্ট থেকেই৷ কীভাবে কীভাবে যেন আমি সেই ফেস্টের দায়িত্বে থাকা কমিটিতে নির্বাচিত হয়ে যাই৷
আস্তে আস্তে টেলিভিশন জগতে গান গাইতে শুরু করা আমার কাছে এটা যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান৷ আর স্কুলে সেই কমিটিতে থাকা মানে বিশাল দায়িত্ব ও সম্মান! কড়া অনুশাসনে চলা কনভেন্ট স্কুলে আমরা ছিলাম একমাত্র দল, যাদের অনুমতি ছিল মোবাইল ফোন নিয়ে স্কুলে আসার৷
প্রথমবার নিজের পরিবারের নামের চাপে নয়, কেবলমাত্র আমার ব্যক্তিগত যোগ্যতায়, সবার মতামত নেবার পরেই এই সুযোগ আমি পেয়েছিলাম৷ ফলে, ভালো কিছু করে নিজের উৎকর্ষ প্রমাণ করবার তাগিদটাও ছিল আগেরবারের চেয়ে অনেক বেশি৷ আর হলোও তাই৷ পুরো অনুষ্ঠান ঢেলে সাজালাম আমরা৷ দিনরাত পড়া ফেলে শুধু ওই ফেস্টের কাজ৷ লাইট, সাউন্ড থেকে স্পন্সরশিপ তোলা, পুলিশের অনুমতি আনানো সব করতাম আমরা আটজন৷
আজ সেই ফেস্টের দিনগুলি থেকে প্রায় ১১ বছর পার করে এসেছি৷ পেছনে তাকালে বুঝতে পারি যে ব্যক্তি, গবেষক, সহকর্মী বা দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার দৃষ্টিভঙ্গির অনেকাংশেই রয়েছে এই দুই স্কুলে পড়ার সময় নেতৃত্বদানের ভিন্ন অভিজ্ঞতা৷ ফেস্টের সময় শিখেছিলাম কীভাবে মঞ্চে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়, যা পরে গিয়ে আমার সংগীত ও টেলিভিশন জীবনে কাজে লেগেছে৷ শুধু তাই নয়, কলেজে ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে প্রতি পদে টের পেয়েছি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাংগঠনিক নেতৃত্বদান৷ এই সব শিক্ষার সাথে সাথে ক্ষমতাকে চিনিয়েছে আমায় সেই ফেস্টই৷ ক্ষমতার অপব্যবহার কাকে বলে, এখন বুঝতে পারি হয়ত৷ কিন্তু যদি আমার প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতার পর দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা না হতো, তাহলে কি আদৌ বুঝতে পারতাম এই ফারাক?
ক্লাসের সমস্ত সহপাঠীদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি আমায় পালন করতে হতো এমন এক দায়িত্বের বোঝা, যা আবার আমার অপছন্দ, তাহলে কী হতো? সারা জীবন গান-বাজনা-নাটক-নাচের দিকে আকৃষ্ট আমি৷ আমার এই নেশাকে কাজে লাগিয়েছিলেন আমার শিক্ষিকারা৷ আমার ভেতর থেকে যে আসলেই একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক বেরোতে পারে, তা আমি অনুধাবন করার আগেই আমার স্কুলের শিক্ষিকারা বুঝেছিলেন৷ গনতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব গঠনের সাথে সাথে তারা মাথায় রেখেছিলেন কোন কাজের জন্য আসলেই কার কতটুকু যোগ্যতা৷
স্কুলে পাঠরত ছেলেমেয়েদের অন্তত একবার হলেও স্কুলের নির্বাচনে বা কোনো ধরনের নেতৃত্বমূলক কাজে অংশ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি৷ দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ছেলেমেয়েদের গণতন্ত্রের পাঠ দেওয়াটা৷ বাবা-মায়ের সামাজিক বা আর্থিক অবস্থান যাতে কোনোভাবেই তাদের সন্তানদের ক্লাসের বা স্কুলের নেতৃত্ব নির্ধারণের উপর কোনো প্রভাব না ফেলতে পারে, তা মাথায় রাখতে হবে৷ নাহলে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরে জন্মাবে না সাম্যের চেতনা৷ তারা কোনোদিন জানবে না যে, ক্ষমতা আয় করতে হয়৷ কোনোমতেই দায়িত্ব বা ক্ষমতার সম্মান বাজারে কিনতে পাওয়া চাল-ডালের মতো পণ্য নয়৷
আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমাদের শিশুরা না শেখে যে, দায়িত্ব মানেই অপার, প্রশ্নহীন ক্ষমতা৷ আমরা চাই না যে তারা শিখুক যে, যার হাতে ক্ষমতা, সেই অপরাজেয়৷ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে আগে নিশ্চিতকরতে হবে সমাজে সার্বিকভাবে গণতন্ত্রচর্চা, যা শুরু হয় শিক্ষাঙ্গন থেকেই৷ ফলে স্কুলের চার দেওয়ালের ভেতর থেকে আসা গণতন্ত্রের বার্তা এক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এখন বুঝে কাজে লাগাতে হবে৷
ব্লগপোস্টটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷