স্কুলে যৌন নিপীড়ন রোধে আদালতের নির্দেশ
২৭ অক্টোবর ২০১৮গত কয়েক মাসে কলকাতার একাধিক স্কুলে শিশু পড়ুয়ার যৌন নিগ্রহের ঘটনা সামনে এসেছে৷ কখনো শিক্ষক, কখনো অশিক্ষক কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে৷ ক্ষিপ্ত অভিভাবকেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্কুলে৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসন, এদের কাজকর্মে অভিভাবকেরা ক্ষুব্ধ৷ তাঁদের বক্তব্য, স্কুলে শিশুদের উপর নিগ্রহের অভিযোগের সুরাহা হয়নি, ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ আন্তরিক নন৷ তাই অভিভাবকরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়া অক্টোবর মাসের গোড়ায় নয়া কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন৷ কলকাতার আটটি প্রথম সারির স্কুলের প্রতিনিধিদের ওই কমিটিতে রাখার কথা বলা হয়৷ রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কমিটির সদস্য স্কুলশিক্ষা দপ্তরের প্রধান সচিব৷ আইন বিশারদ থেকে ইউনিসেফের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত আদালতের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে৷ এই কমিটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছে৷
সদস্যরা এই আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি করবেন একটি নির্দেশিকা, যার লক্ষ্য হবে স্কুলে শিশুদের যৌন হেনস্থায় লাগাম টানা৷ ১২ নভেম্বর এই নির্দেশিকা আদালতে জমা দিতে হবে কমিটিকে৷ নির্দেশিকায় বলতে হবে, শিশুদের যৌন নিগ্রহ কীভাবে রোখা সম্ভব৷ কী হতে পারে পথ ও পদ্ধতি৷ ওই তারিখেই হবে অভিভাবকদের দায়ের করা মামলার পরের শুনানি৷ নির্দেশিকা খতিয়ে দেখে পরবর্তী নির্দেশ দেবে কলকাতা হাইকোর্ট৷
আদালতের এই পদক্ষেপ কিছুটা আশ্বস্ত করেছে শহরের অভিভাবকদের৷ মলয়কান্তি সরকারের সন্তান কলকাতার একটি নামী স্কুলের পড়ুয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালতের এই নির্দেশ অবশ্যই স্বস্তি দিয়েছে৷ তবে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি৷ এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ কঠোর নির্দেশিকা জারি হলেই হবে না, স্কুল সেটা কতটা মেনে চলছে ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষার স্বার্থে, সেটাও বড় ব্যাপার৷''
রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্য সুদেষ্ণা রায় ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কিছুদিন আগে এ ধরনের একটি নির্দেশিকা আমরা প্রকাশ করেছি৷ একটি রিপোর্ট ও পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছে, যার লক্ষ্য স্কুলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা৷ প্রতিটি স্কুলে শিশুদের পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা৷'' তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে গিয়ে একটি শিশু যৌন হেনস্থার মুখে পড়বে, এর থেকে খারাপ ঘটনা কী হতে পারে৷ অভিভাবকরা চাইছেন, শুধু নির্দেশিকা জারি নয়, কঠোরভাবে তা কার্যকর করা হোক৷ নইলে এসব পদক্ষেপ কাগজে-কলমেই রয়ে যাবে৷''
স্কুলে শিশুর হেনস্থার ঘটনার আরেকটি ভয়াবহ দিক, শিক্ষকদের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠা৷ গত নভেম্বরে জি ডি বিড়লা স্কুলে একটি তিন বছরের শিশুকে নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে৷ যে সমাজে একটা সময় মনে করা হতো, শিশুর বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেন তার শিক্ষকরা, সেখানে এ ধরনের অভিযোগ আলোড়ন তুলবেই৷ এই অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই স্তম্ভিত করেছে সবাইকে৷ শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের প্রা্ক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুরও ক্ষুব্ধ৷ তিনি বললেন, ‘‘এটাকে পশুত্ব ছাড়া কী বলব৷ মানুষের মধ্যে যে পাশবিক প্রবৃত্তি রয়েছে তারই প্রকাশ৷ এই ভাইরাস থেকে মুক্তির পন্থা ঠিক করা খুবই কঠিন৷ এই সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না৷'' অতীতের শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে আজকের পৃথিবীর নয়া মূল্যবোধের প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ৷ সুপ্রিয় ঠাকুরের ভাষায়, ‘‘আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না, এমনটা নয়৷ তবে এতটা সামনে আসত না৷ এখন মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে৷ তাই এত বেশি ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে৷''
জি ডি বিড়লায় অভিযুক্ত ছিলেন শিক্ষকরা, এম পি বিড়লা স্কুলে অভিযোগ উঠেছিল অশিক্ষক কর্মীর বিরুদ্ধে৷ এ বছরে দক্ষিণ কলকাতার দুটি স্কুল, বেহালার একটি প্লে স্কুলে শিশু পড়ুয়ার যৌন হেনস্থার ঘটনায় শোরগোল হয়েছে৷ এই মাসেই ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী গার্লস স্কুলে প্রাথমিক বিভাগের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ উঠেছে স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে৷
অভিভাবকদের অভিযোগ, ২৪ সেপ্টেম্বর হেনস্থার শিকার হয় ছাত্রীটি৷ মেয়ে বাড়ি ফিরে অসুস্থ বোধ করায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়৷ এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর স্কুলে বিক্ষোভ দেখান অভিভাবকরা, ভাঙচুরও করা হয় বলে অভিযোগ৷ বিনোদিনী গার্লসের প্রধান শিক্ষিকা দীপান্বিতা রায়চৌধুরী নির্দিষ্টভাবে এই ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি৷ তবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দীপান্বিতা বলেন, ‘‘কমিটি করে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না৷ সমাজে পচন ধরেছে, এটা তারই প্রতিফলন৷ স্কুল সমাজেরই অংশ, সেখানে এই ঘটনা ঘটলে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দরকার আত্মশিক্ষা৷'' তিনি আরো মনে করেন, ‘‘অভিযোগ উঠলেই কোনো শিক্ষককে দোষী হিসাবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়৷ আগে দেখতে হবে, আদৌ হেনস্থা হয়েছে কিনা৷''
এসব অভিযোগ, টানাপোড়েন, আইনি লড়াইয়ের মধ্যে আড়ালেই থেকে যায় শিশুটি৷ মনোচিকিৎসক কামাল হোসেন বলেন, ‘‘নিগ্রহের পর শিশু যে কতটা ট্রমার মধ্যে থাকে, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করি না৷ এই ঘটনা তার উপর আজীবন প্রভাব রাখতে পারে৷ তার ব্যক্তিত্বের গঠন বদলে দিতে পারে৷ স্কুলে নজরদারি অবশ্যই থাক, তাতে আরো গুরুত্ব দেওয়া হোক, কিন্তু শিশুর আতঙ্ক দূর করে তাকে স্বাভাবিক করে তোলার উপর সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত৷''
আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷