পশ্চিমবঙ্গের কৃষি পণ্য
১৩ এপ্রিল ২০১৪ভারত থেকে যত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়, তার মধ্যে কৃষিজ পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে সবথেকে দ্রুত হারে৷ এর মধ্যে বাসমতী চাল বা দার্জিলিং চা তো আছেই, আছে নানা ধরনের ফল, শাক-সবজি এবং পান, যার এক বড় অংশের জোগানদার পশ্চিমবঙ্গ৷ বিশেষ করে পালং শাকের মতো সবুজ পাতাওয়ালা সবজি, ইংরেজিতে যাকে গ্রিন লিফি ভেজিটেবল বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে তার ফলন যথেষ্ট বেশি এবং বিদেশের বাজারে তার চাহিদাও যথেষ্ট৷ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে অনেক সময়ই পশ্চিমবঙ্গের কৃষি পণ্য বাতিল হয়ে ফেরত চলে আসছে৷
অবশ্য এমন বলাটা ঠিক হবে না যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গই এই দায়ে অভিযুক্ত৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই অস্ট্রেলিয়া ভারতকে সতর্ক করে দিয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে৷ ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে দুগ্ধজাত পণ্য অস্ট্রেলিয়ায় নিয়মিত রপ্তানি হয়, কিন্তু অনেকসময়ই ব্যবহৃত দুধের গুণমান ঠিক থাকে না৷ গত বছর যেমন একই কারণে ভারতীয় চাল এবং চিনেবাদামের রপ্তানি বেশ কয়েক মাস বন্ধ রেখেছিল রাশিয়া৷
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের চরিত্রটা আরও একটু বিপজ্জনক৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে সংস্থা বিদেশ থেকে আমদানি করা কৃষিজ পণ্যের গুণমান যাচাই করে ছাড়পত্র দেয়, তারা অতীতে একাধিকবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা শাক-সবজিতে পোকা এবং আণুবীক্ষণিক জীবাণুর সন্ধান পেয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করেছে সমস্ত পণ্য৷ এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যথাবিহিত সতর্কও করা হয় ভারত সরকারের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরকে৷ যার দরুণ চলতি এপ্রিল মাস থেকে নিয়ম হয়েছে, কেন্দ্রীয় দপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনো কৃষিজ পণ্য সরাসরি রপ্তানি করা যাবে না ইউরোপীয় ইউনিয়নে৷
ইইউ-র সতর্কবার্তা পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রককেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল, উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে রাজ্য সরকারের যে খাদ্য প্রক্রিয়ণ কেন্দ্রে কৃষিজ পণ্য পরিশোধন করে প্যাকেট করা হয়, সেই কেন্দ্রের জীবাণুনাশক ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত করতে৷ কিন্তু তাতেও যে টনক নড়েনি রাজ্য সরকারের, তা বোঝা গেল, যখন কেন্দ্রীয় পরীক্ষকেরা পশ্চিমবঙ্গের ‘রপ্তানিযোগ্য' শাক-সবজিতে আবারও জীবাণুর সন্ধান পেলেন! তার পরেই ওদের যেটা মনে হয়েছে যে ভাগ্যিস সরাসরি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল! নয়ত বার বার একই স্বাস্থ্যজনিত কারণে ভারতের কৃষিজ পণ্য বাতিল হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘমেয়াদী নিষেধাজ্ঞা গোটা দেশের ওপরেই জারি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল৷ সেইটা যে অন্তত এড়ানো গিয়েছে, তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন ওঁরা৷
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরেরই কোনো হেলদোল নেই৷ যে কারণে প্রতিবার এ রাজ্যের কৃষিপণ্যে অশুদ্ধতা ধরা পড়ছে, তা শুনলে যে কোনো যুক্তিবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ স্রেফ আঁতকে উঠবেন! কৃষিপণ্যকে জীবাণুমুক্ত করার যে যান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেটিই অকেজো বারাসাতের সরকারি খাদ্য প্রক্রিয়ণ কেন্দ্রে৷ যদিও পদ্ধতিটা খুব জটিল কিছু আদৌ নয়৷ ক্ষেত থেকে আনা শাক-সবজি প্রাথমিক ঝাড়াইবাছাই এবং ধোয়াধুয়ি করার পর, তাকে জীবাণুমুক্ত করতে নিমের দ্রবণের সাহায্যে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়৷ এটি পরপর দুটি পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায় – হট প্রসেস এবং কোল্ড প্রসেস৷ তার পর, প্যাকেটে ভরার আগে ডি-হিউমিডিফায়ার যন্ত্রের সাহায্যে সবজির অতিরিক্ত জলীয় অংশ শুষে নেওয়া হয়, যাতে প্যাকেটবন্দি সবজি পচে নষ্ট না হয়ে যায়৷
বারাসাতে রাজ্য সরকারের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়ণ কেন্দ্রে গোটা কাজটিই হয় মানুষের হাতে হাতে! অর্থাৎ জীবাণুনাশক নিমের জল দিয়ে সবজি ধোয়ার কাজটা হাতেই করা হয় এবং তার পর সেই সবজি মাটিতে পাতা প্লাস্টিকের চাদরে রেখে শোকানো হয়! তার ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়৷ জীবাণুমুক্ত হওয়ার বদলে আরও বেশি জীবাণু এসে জমা হয় পাতায় পাতায়৷ সঙ্গত কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সচেতন দেশের ছাড়পত্র পাওয়ার যোগ্য থাকে না সেই পণ্য!
মজার কথা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের হুঁশিয়ারি পাওয়ার পর, অকেজো যান্ত্রিক ব্যবস্থা মেরামতির বদলে নতুন করে রঙ হয়েছিল সরকারি খাদ্য প্রক্রিয়ণ কেন্দ্রটি, বাতানুকূল যন্ত্রগুলি সাফ করা হয়েছিল৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা তাতে সন্তুষ্ট হননি৷ এর পর যদি কারও পাল্টা অভিযোগ শোনা যায় যে, ‘চক্রান্ত' করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিপণ্যকে রপ্তানির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা হলে আর কীই বা করার থাকতে পারে!