তবে অত পিছনে যাওয়ার দরকার নেই, তেলেঙ্গানার এসিবি গত জানুয়ারিতে একজন সরকারি অফিসারের বাড়ি থেকে একশ কোটি টাকার বেশি অর্থ উদ্ধার করেছে। হায়দরাবাদের মোট ২০টি জায়গায় তারা তল্লাশি চালিয়েছিল। গতমাসেই তো মহারাষ্ট্রে এক আইপিএস অফিসারের স্বামীর কাছ থেকে ১৫০ কোটি টাকার সম্পত্তির দলিল উদ্ধার করেছে ইডি। মুম্বই ও থানে মিলিয়ে তার ১৭টি বাড়ি আছে। তাকে এখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এটা হলো হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আইএএস অফিসাররা হলেন প্রশাসনের শীর্ষে থাকা অফিসার। তারা প্রচুর বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার অধিকারী। তা সত্ত্বেও একের পর এক শীর্ষপদে থাকা অফিসার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। আর যাদের নামে অভিযোগ নেই, তাদের অনেকের জীবনযাপন ও নিজের নামে বা বেনামে সম্পত্তির পরিমাণের বহর দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। নিন্দুকেরা বলেন, উত্তরপ্রদেশের সাবেক ও বর্তমান সরকারি অফিসারদের নয়ডায় কটা বাড়ি স্বনামে-বেনামে আছে, সেই হিসাবটা সামনে এলেই আর দেখতে হবে না। একের পর এক প্রাসাদোপম সেই সব বাড়ি কী করে তারা করলেন, তার হিসাব কয়জন দিতে পারবেন!
আমার এক পরিচিত সাংবাদিক অকাল অবসর নিয়ে পূর্ব ভারতে নিজের গ্রামে চলে গেছেন। তিনি নির্দল হয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছেন। তারপরেই তার চোখ খুলে গেছে। প্রতিটি প্রকল্পে ২০ শতাংশ কাট বাঁধা। সেই কাটমানি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত যায়। দেয়া-নেয়া করে সকলের বেঁচে থাকা আর কী। ।
এই কাটের ফাঁদ তো গোটা ভরত জুড়ে পাতা। গ্রাম থেকে শহর, রাজ্য থেকে কেন্দ্র। সরকারে আর কিছু থাক বা না থাক, প্রকল্পের অভাব নেই। প্রকল্প থাকলেই কাটের কাহিনিও সেখানে ঢুকে পড়ে। মানুষ দরকারে সরকারি অফিসে যান। তারপর বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা-র মতো অবস্থা হয়। এই টেবিল থেকে অন্য টেবিল কত আর ঘোরা যায়! ফলে নজরানা দিয়ে দেয়াই ভালো। সিস্টেম তো চলতে হবে।
আমার আর এক বন্ধুর অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক। ব্যবয়াসী বন্ধু বলছিলেন, এখন স্মার্ট ফোন এসে যাওয়ার পর অধিকাংশ সরকারি কর্মী ধরা পড়ার ভয়ে আর হাতে হাতে ঘুষ নেন না। তাদের হয়ে দালাল থাকে। অফিসের বাইরে কিছু দালাল তাদের হয়ে সেই টাকাটা নেন। তার থেকে তারাও কাট পান। সরকারি কর্মকর্তারা অফিসের বাইরে থাকা ওই মানুষটির কাছে সবাইকে পাঠিয়ে দেন। তিনি জানিয়ে দেন, কত দিতে হবে। তারপর টাকার বিনিময় হয়। কাজও হয়। সিস্টেম তো চলতে হবে।
তাহলে কি পুলিশ-প্রশাসন-বিভিন্ন দপ্তরে থাকা আমলাকুল সকলেই অসৎ? তা কী করে হবে? সৎ আমলা অবশ্যই আছেন। তারা বিলুপ্ত প্রজাতির জীব নন। তারা প্রতিটি দপ্তরেই আছেন। এমনই এক সাবেক আমলার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার অভিজ্ঞতা হলো, দুই ধরনের সৎ অফিসার আছেন। একদল সৎ ও দক্ষ। আরেক দল সৎ, কিন্তু কাজের নয়, অকর্মন্য যাকে বলে। দীর্ঘ সরকারি চাকরি জীবনে তিনি দ্বিতীয় দলের অফিসারদের পছন্দ করতেন না। তিনি সৎ ও দক্ষ অফিসার পেলে তার উপর নির্ভর করতেন। তা না হলে, তিনি অসৎ ও দক্ষ অফিসারদের দায়িত্ব দিতেন, তবে সেক্ষেত্রে একটা কৌশল নিতেন। ওই অফিসারের নিচে বেশ কয়েকজন সৎ অফিসারকে দিতেন। আর আগাগোড়া ওই দক্ষ অসৎ অফিসারের উপর নজর রাখতেন।
কিন্তু সৎ থাকার জন্য অনেকসময় আমলাদের একটা মূল্য দিতে হয়। ওই অফিসারকে সমানে পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে তো রেকর্ড করে ফেলেছেন অশোক খেমকা। দপ্তরের দুর্নীতি ধরে ফেলার পর ৩০ বছরে ৫৬ বার বদলি করা হয়েছে তাকে।
আসলে সততার যে একটা দাম আছে, তা দিল্লির ক্ষমতার করিডোরে একটু ঘুরলেই বোঝা যায়। সেই মূল্য অনেক সময় জীবন দিয়েও দিতে হয়। এরকম ঘটনা কমবেশি অনেক রাজ্যেই ঘটেছে। স্বার্থে আঘাত লাগলে, দুর্নীতিগ্রস্তরা মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার ওই পরিচিত সাবেক অফিসারও বলছিলেন, তার চেনা আদ্যন্ত সৎ ও কড়া অফিসারকে মেরে দিয়েছিল মাফিয়ারা। কিন্তু তারও অভিজ্ঞতা হলো, তারপরেও সৎ আমলারা থাকেন। এই সিস্টেমের মধ্যে লড়াই করে তারা সততার সঙ্গে কাজ করেন। আর সেজন্য দুর্নীতি সত্ত্বেও দেশ এগোয়। সৎ ও অসৎ মিলেই সরকার সচল থাকে।
তবে এই ব্যাপারে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি একটি প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি মন্ত্রী ও আমলাদের নাম করে করে বলেছেন, তারা টাকা নিয়ে কলকাতায় সরকারি জমি জবরদখলকারীদের বসিয়েছেন। তারপর নির্দেশ দিয়েছেন, ১৫ দিনের মধ্যে সরকারি জমি জবরদখলমুক্ত করতে হবে। কলকাতায় এখন বিভিন্ন জায়গায় দোকান ভাঙা হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই, সরকারি জমি জবরদখল করা যায় না। করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু বৈঠকে যাদের নাম করে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তাদের ক্ষেত্রে কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না? মন্ত্রী-আমলারা কিন্তু আগের মতোই থেকে যাবেন। সিস্টেমটা তো বজায় রাখতে হবে।