সড়ক দুর্ঘটনায় সাজা ১০ ভাগেরও কম!
২৮ মে ২০১৮ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কেমন?
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ: বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি৷ সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা আমাদের রয়েছে, যার কারণে দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে৷
সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার হার কেমন?
সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার সংখ্যা অত্যন্ত কম৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন, তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হন না৷ খুবই কম সংখ্যক মামলা থানায় লিপিবদ্ধ হয়৷ আর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি যা হয়,আমার মনে হয় তা ১০ ভাগেরও কম৷ এর কারণ হলো দীর্ঘ সময় ধরে আদালতে সাক্ষী দেয়া বা দুর্ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন বলে৷ আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকেই এই প্রক্রিয়ায় যান না৷ তাছাড়া সাধারণ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যাঁরা গাড়ির চালক থাকেন বা মালিক থাকেন, তাঁরা মিটমাট করে নেন কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে৷ এ কারণে মামলাগুলো চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত আসে না৷
সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আমাদের যে আইন, সেটা কত সালের? এটা কি পর্যাপ্ত?
মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স আমাদের দেশে যেটা আছে, সেটা আশির দশকের আইন৷ এখানে সাজা ছিল তিন বছরের৷ আমরা রিট করেছিলাম৷ সেখানে আদালত সাজা বাড়িয়ে সাত বছর করে৷ তারপরও আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে যে, এই সাজাটাও কম৷ আইন সংশোধন করতে বলেছে আদালত৷ সেই আইনে যে বিধান আছে, সেটা কার্যকর করা গেলেও সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই আইনের প্রয়োগ হয় না৷ মালিক, ড্রাইভার, পথচারী – কেউ সেটা মানতেও চান না৷ এ কারণে দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে৷
এই আইনটার দুর্বলতা কোথায়?
মূল দুর্বলতা হলো সাজার পরিমাণ কম৷ আর প্রাথমিক স্তরে এখানে যে জরিমানা, সেটা এতই কম যে যাঁরা জরিমানা দেন তাঁদের কাছে এটা সহনীয়৷ এ কারণে এটা খুব একটা কার্যকর হয় না৷ যেমন ধরুন রং ড্রাইভিং, রং পার্কিং বা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া চালানো – এগুলো করলে বিদেশে অনেক টাকা জরিমানা হয়৷ ফলে সেখানকার মানুষ এ ধরনের অপরাধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন৷ আমাদের দেশে এটা খুবই কম৷ ৫০০ টাকা বা এক হাজার টাকা জরিমানা করা হলে মালিক সেটা দিয়ে চলে যান৷ এবং পরবর্তীতে আবারো একই কাজ করতে দ্বিধা করেন না৷
বিদেশের সঙ্গে আমাদের আইনের পার্থক্য কী?
এই যে আমাদের সাজা কম৷ ক্যানাডায় ১০ বছরের সাজা৷ এমনকি অনেক দেশেই যাবজ্জীবন সাজা আছে৷ এছাড়া বিদেশে আরেকটা জিনিস আছে, যেটা আমাদের দেশে নেই৷ বহু দেশে সাজা বা জরিমানার সঙ্গে অপরাধের মাত্রা ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে পয়েন্ট কাটা হয়৷ যেমন কোনো অপরাধের জন্য এক পয়েন্ট বা দুই পয়েন্ট৷ এভাবে নির্দিষ্ট একটা পয়েন্ট কাটার পর ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করা হয়৷ তার মানে সেই ব্যক্তি আর কোনোদিনই লাইসেন্স পাবেন না৷ এ কারণে তাঁরা সতর্ক থাকেন৷ এটা আমাদের এখানে করা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি বিআরটিএ-র একজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাঁরাও এটা নিয়ে ভাবছেন৷ আমাদের দেশে একটা দুর্ঘটনার পর জরিমানা দিলেন, মামলা হলো, কিন্তু লাইসেন্সের ওপর এর প্রভাব পড়লো না৷ ফলে কেউ-ই এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না৷
আমরা কেন আইনে এটা আনতে পারছি না?
আমাদের এখানে যাঁরা সরকারি দায়িত্বে আছেন, এটা তাঁদের মাথা থেকে বের হতে হবে৷ তা না হলে আমরা যখন বলব, তখন কতটা তাঁরা নেবেন তা বলা মুশকিল৷ বিআরটিএ-র পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাঁরা বলেছেন যে তাঁরা এটা করবেন৷ আশা করি ভবিষ্যতে তাঁরা সত্যিই লাইসেন্স থেকে পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থা করবেন৷ এটা করলে একজন ড্রাইভার যখন দেখবেন যে একটা, দু'টো বা চারটা অ্যাক্সিডেন্ট করলে আমার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে, তখন অবশ্যই তাঁরা সতর্ক হবেন৷
আইন শক্ত করে কি সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব?
আইন হলো একজনের মনে ভয়ভীতির সৃষ্টি করা, যাতে সে দ্বিতীয়বার এ কাজ না করে৷ এখানে শুধু আইনের প্রয়োগই না, আমরা যারা পথচারী তাদেরও অগ্রসর হতে হবে৷ কয়েকদিন আগে দেখলাম, চলন্ত বাসে একজন মাথা বাইরে বের করে রেখেছেন, হাত বের করে রেখেছেন৷ তাঁদের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷ জেব্রা ক্রসিং ছাড়াই আমরা হুট করে রাস্তা পার হচ্ছি৷ এতেও দুর্ঘটনা ঘটে৷ এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের অসতর্কতা বা নিবুর্দ্ধিতাও অনেক সময় দায়ী৷ এ সব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে অনেক কাজ করতে হবে৷ এখানে গাড়ি, মালিক, চালক, পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে৷ পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব৷
আমাদের দেশে যত ড্রাইভার আছেন, তাঁদের সবার তো লাইসেন্সই নেই৷ তাই না?
এটা তো মৃত্যুর লাইসেন্স দেয়া৷ একজনের যদি লাইসেন্স না থাকে আর সে যদি গাড়ি চালায়, তাহলে সেই গাড়িতে দুর্ঘটনা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক৷ পরীক্ষা না দিয়েই ৭-৮ হাজার মানুষকে সরকার লাইসেন্স দিতে চেয়েছিল৷ আমরা মামলা করে সেই লাইসেন্স দেয়া আটকিয়েছি৷ আপনি যদি নিয়ম-কানুন না জানেন, তাহলে গাড়ি চালালে আপনার হাতে শত শত মানুষের মৃত্যু হওয়াটাই তো স্বাভাবিক৷
সড়ক দুর্ঘটনার কী পরিমাণ মামলায় সাজা হচ্ছে?
সাজার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম৷ ইদানীং দু-চারটা মামলায় সাজা হয়েছে৷ মিশুক মনিরদের মামলায় হাইকোর্টে বিচার হওয়ায় সাজা হয়েছে৷ এর আগে একজন ট্রাক ড্রাইভার ইচ্ছাকৃতভাবে একজনকে হত্যা করেন৷ সেই মামলায় সাজা হয়েছে৷ এটা নিয়ে মালিক ও ড্রাইভাররা হরতাল ডেকেছিল, আদালতের বিরুদ্ধে৷ তখন আমরা একটা মামলা করেছিলাম৷ এরপর তারা হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়৷ তবে সাজা বৃদ্ধি করাটা খুবই জরুরি৷
আরেকটা আলোচিত মামলা ছিল, সংবাদের সাবেক বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর মৃত্যুর ঘটনা...
হ্যাঁ, এটা তো আপিল বিভাগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে৷ এখন তারা যদি টাকা না দেয় তাহলে আদালতের মাধ্যমে অবমাননার মামলা করে টাকাটা উদ্ধার করতে হবে৷ কিন্তু এটা করতেই তো ২৭ বছর লেগে গেছে৷ আমাদের অনেকেই এ ধরনের বিষয়গুলোতে নিয়মগুলো জানেন না৷ একটা তো ফৌজদারি মামলা হবে৷ তার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ চেয়েও আপনি একটা মামলা করতে পারেন৷ তবে সেটা ছ'মাসের মধ্যে জেলা জজের কাছে করতে হয়৷ না জানার কারণে অনেকেই সাধারণত এই ধরনের আবেদন করেন না৷ এখানে কোনো দুর্ঘটনার পর ড্রাইভার গ্রেপ্তার হলেও তিনি জামিন পেয়ে যান৷ এটা অজামিনযোগ্য করা হলে হয়ত বিষয়টা কঠিন হতো৷ সরকারের কাছে সাজেশন থাকবে, তারা যেন একটা মহাপরিকল্পনা করে, জরুরি বিষয় বিবেচনা করে মামলাটা যেন রিশাফল করে৷ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার এমন একটা কিছু যেন করে, যাতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷