1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
রাজনীতিপোল্যান্ড

হাজারো বাংলাদেশিকে রক্ষায় এক অনির্বাণের ছুটে চলা

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মূলত রাজনীতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শরণার্থী এবং অভিবাসন সম্পর্কিত ইস্যু কভার করেন৷ পাশাপাশি জার্মানি ও ইউরোপে জীবনযাপনের নানা দিকও তুলে ধরেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম
৪ মার্চ ২০২২

অনির্বাণ নিয়োগী৷ পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের মেডিকায় পৌঁছানোর পরেই এক বাংলাদেশি শরণার্থীর কাছে শুনি তার নাম৷ ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বাঁচতে পোল্যান্ডে পাড়ি দিতে চাওয়া বাংলাদেশিদের সহায়তায় সদা তৎপর তিনি৷

https://p.dw.com/p/482gO
Polen Medyka Grenze zu Ukraine | Flüchtende aus Asien
পোলিশ সীমান্তে কয়েকজন বাংলাদেশি শরণার্থীর সঙ্গে অনির্বাণ নিয়োগী (বামে)ছবি: Arafatul Islam/DW

পোলিশ সীমান্তে তাপমাত্রা রাতের বেলা মাইনাস ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি নেমে যায়৷ দিনের বেলা থাকে শূন্যের কাছাকাছি৷ আর সেই পরিবেশের মধ্যে সীমান্তের ইউক্রেন অংশে তিন থেকে পাঁচদিন অবধি অপেক্ষায় থাকেন একেকজন বাংলাদেশি শরণার্থী৷ অবশ্য শুধু বাংলাদেশি নয়, ইউক্রেনীয় নাগরিকরা ছাড়া এশিয়া, আফ্রিকার অনেক শরণার্থীরই অভিযোগ একইরকম৷ পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের ইউক্রেন অংশে পৌঁছাতে ৩৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার অবধি পথ পায়ে হাঁটতে হয়৷ এরপর নানা বাহানায় নাকি তাদের কখনো লাইন থেকে বের করে দেয়া হয়, কখনো রুঢ় ব্যবহার করা হয় তাদের সঙ্গে৷ সেখানে খাওয়া, ঘুমানোরও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই৷

এতসব বাধা ডিঙিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করার পর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত শরণার্থীরা একটু গরম আশ্রয় খোঁজেন, যেখানে খানিকটা জিরিয়ে নেয়া যাবে আর শান্তিতে কিছু খাওয়া যাবে৷ সীমান্তে পৌঁছানোর পরেই দেখেছি ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দিতে উন্মুখ হয়ে আছে অনেক পোলিশ নাগরিক৷ তারা তাদের জন্য গরম পোশাক, গরম খাবার, চিকিৎসার আয়োজন রেখেছে সীমান্তে৷ নিজেদের ঘর-বাড়িতে যতটা সম্ভব তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করছে৷ এমনকি শত শত মাইল দূর থেকেও অনেকে এসেছেন সীমান্ত থেকে ইউক্রেনীয়দের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে৷ 

সোমবার বিকেলে মেডিকাতে পৌঁছেই এসব দেখেছি৷ ইউরোপীয়দের এত আয়োজনের মধ্যে বাংলাদেশি, ভারতীয়দের জন্য আলাদা কিছু আছে কিনা সেটাও খুঁজছিলাম মনে মনে৷ তবে সন্ধ্যায় দুয়েকজনের কাছে অনির্বাণ নিয়োগীর নাম শোনা ছাড়া আর কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি৷

তাকে দেখতে পেয়েছি অবশ্য পরেরদিন দুপুরে৷ সদ্য একটা লাইভে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য বাস, হোটেল, খাবারসহ নানা সুবিধার কথা জানানোর পর এক শরণার্থী জানালেন বাংলাদেশিদের জন্যও একইরকম সুবিধা আছে৷ ঐ যে দূরে একটি বাস দাঁড়িয়ে আছে৷ 

সরেজমিনে পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্ত

বাসের গায়ে বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম আর দূতাবাসের কথা দেখে বুঝলাম ঘটনা সত্য৷ মঙ্গলবার এই বাসটির আয়োজন করা হয়েছে৷ সেই বাসের সামনেই আরেক গাড়িতে বসে ছিলেন পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা অনির্বাণ নিয়োগী৷ সারাক্ষণ মোবাইলের দিকে নজর তার৷ একটু পরপর বের হয়ে চলে যান সীমান্তের কাছে, ফেরেন কয়েকজন বাংলাদেশিকে সঙ্গে নিয়ে৷

আমি কথা বলা শুরু করতেই চিনে ফেললেন৷ জানালেন, ডয়চে ভেলের সংবাদ নিয়মিত দেখেন তিনি৷ তবে, প্রচারবিমুখ মানসিকতা স্পষ্ট তার মধ্যে৷ কিছুটা কথা হতেই আবার ছোটেন সীমান্তের দিকে৷ কিছুটা পা টেনে টেনে হাঁটছিলেন, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ বোঝা যাচ্ছিল৷ টানা কয়েকদিনের পরিশ্রমে এই অবস্থা হয়েছে তার৷ এরই মধ্যে জানালেন, একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি৷ 

পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের কাছে অবস্থান করা একমাত্র বাংলাদেশি কূটনীতিক অনির্বাণ নিয়োগী৷ ইউক্রেন থেকে সাহায্যের অসংখ্য বার্তা প্রতিনিয়ত তার কাছে আসছিল৷ কেউ কেউ সীমান্ত পার হতে গিয়ে আটকে যাচ্ছিলেন, কেননা, পাসপোর্ট বা প্রয়োজনীয় ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই৷ এমন বাংলাদেশিরাও চাচ্ছিলেন সীমান্ত পার হতে৷

আমি মেডিকাতে মঙ্গলবার থাকাকালেই একটি খবর শুনেছিলাম যে, অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশিকে আটকে রেখেছে পোল্যান্ডের বর্ডার পুলিশ৷ অনির্বাণ নিয়োগী তাদের ছাড়াতে আমার সামনেই নানা জায়গায় ফোন করেছেন, নানাভাবে তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন৷

সেদিন অবশ্য তাদের কাছে যেতে পারেননি তিনি৷ তবে পরের দুই দিনে এরকম আটক বেশ কয়েকজনকে মেডিকার পাশের শহর সেমিশেল থেকে উদ্ধার করেছেন তিনি৷ কাগজপত্রের ঘাটতি থাকা এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন তিনি, পোলিশ কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা বাংলাদেশি৷ এরকম নানাভাবে কয়েকশত বাংলাদেশিকে মেডিকা সীমান্ত থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশে সহায়তা করেছেন এই কূটনীতিক৷

বিপদের সময় দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে যে কাজটি করতে হয়, ঠিক সেটাই নিরলসভাবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে করছেন অনির্বাণ নিয়োগী৷ বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল তার মতো আরো কয়েকজনকে সীমান্ত এলাকায় পাঠানো৷ তিনি একা যতটা সম্ভব সামাল দিয়েছেন বটে, তবে সেটা যথেষ্ট ছিল না৷

কিছুক্ষেত্রে বাংলাদেশি শরণার্থীরা হয়ত কাঙ্খিত সহায়তা পাননি, কেননা, দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিকভাবে হয়নি বা যে সীমান্তে অনিবার্ণ নিয়োগী ছিলেন, সেই সীমান্তের বদলে অন্য সীমান্ত দিয়ে হয়ত বাংলাদেশিরা পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ বাংলাদেশ সরকার আরো লোকবল নিয়োগ করলে এই বিষয়টি এড়ানো যেতো৷ পাশাপাশি এখনো যারা ইউক্রেনে আটকে আছেন, তাদের উদ্ধারে সরকারের আরো দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার৷ লোকবলের ঘাটতি সেই বিষয়টিকেও পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে৷ 

Arafatul Islam Kommentarbild App
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে

এখানে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, অনিবার্ণ নিয়োগীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন একদল পোল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি৷ শুধুমাত্র দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাকরিবাকরি ভুলে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে দিনের পর দিন অবস্থান করছেন তারা৷ কখনো তীব্র শীতের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থেকে শরণার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন তারা, কখনোবা গাড়িতে করে তাদের পৌঁছে দিচ্ছেন কোনো নিরাপদ ঠিকানায়৷ অনেককে সাময়িক আশ্রয়ও দিচ্ছেন পোল্যান্ড প্রবাসীরা৷

বাংলাদেশিদের পাশে বাংলাদেশের কূটনীতিক, প্রবাসীদের এভাবে দাঁড়াতে দেখে ভালো লেগেছে৷ মনে হয়েছে চারদিকে অসংখ্য হতাশার মধ্যে এটা এক আশার আলো৷ এই আলোর পরিধি যত বাড়বে, ততই মঙ্গল৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য