পোলিশ সীমান্তে তাপমাত্রা রাতের বেলা মাইনাস ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি নেমে যায়৷ দিনের বেলা থাকে শূন্যের কাছাকাছি৷ আর সেই পরিবেশের মধ্যে সীমান্তের ইউক্রেন অংশে তিন থেকে পাঁচদিন অবধি অপেক্ষায় থাকেন একেকজন বাংলাদেশি শরণার্থী৷ অবশ্য শুধু বাংলাদেশি নয়, ইউক্রেনীয় নাগরিকরা ছাড়া এশিয়া, আফ্রিকার অনেক শরণার্থীরই অভিযোগ একইরকম৷ পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের ইউক্রেন অংশে পৌঁছাতে ৩৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার অবধি পথ পায়ে হাঁটতে হয়৷ এরপর নানা বাহানায় নাকি তাদের কখনো লাইন থেকে বের করে দেয়া হয়, কখনো রুঢ় ব্যবহার করা হয় তাদের সঙ্গে৷ সেখানে খাওয়া, ঘুমানোরও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই৷
এতসব বাধা ডিঙিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করার পর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত শরণার্থীরা একটু গরম আশ্রয় খোঁজেন, যেখানে খানিকটা জিরিয়ে নেয়া যাবে আর শান্তিতে কিছু খাওয়া যাবে৷ সীমান্তে পৌঁছানোর পরেই দেখেছি ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দিতে উন্মুখ হয়ে আছে অনেক পোলিশ নাগরিক৷ তারা তাদের জন্য গরম পোশাক, গরম খাবার, চিকিৎসার আয়োজন রেখেছে সীমান্তে৷ নিজেদের ঘর-বাড়িতে যতটা সম্ভব তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করছে৷ এমনকি শত শত মাইল দূর থেকেও অনেকে এসেছেন সীমান্ত থেকে ইউক্রেনীয়দের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে৷
সোমবার বিকেলে মেডিকাতে পৌঁছেই এসব দেখেছি৷ ইউরোপীয়দের এত আয়োজনের মধ্যে বাংলাদেশি, ভারতীয়দের জন্য আলাদা কিছু আছে কিনা সেটাও খুঁজছিলাম মনে মনে৷ তবে সন্ধ্যায় দুয়েকজনের কাছে অনির্বাণ নিয়োগীর নাম শোনা ছাড়া আর কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি৷
তাকে দেখতে পেয়েছি অবশ্য পরেরদিন দুপুরে৷ সদ্য একটা লাইভে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য বাস, হোটেল, খাবারসহ নানা সুবিধার কথা জানানোর পর এক শরণার্থী জানালেন বাংলাদেশিদের জন্যও একইরকম সুবিধা আছে৷ ঐ যে দূরে একটি বাস দাঁড়িয়ে আছে৷
বাসের গায়ে বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম আর দূতাবাসের কথা দেখে বুঝলাম ঘটনা সত্য৷ মঙ্গলবার এই বাসটির আয়োজন করা হয়েছে৷ সেই বাসের সামনেই আরেক গাড়িতে বসে ছিলেন পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা অনির্বাণ নিয়োগী৷ সারাক্ষণ মোবাইলের দিকে নজর তার৷ একটু পরপর বের হয়ে চলে যান সীমান্তের কাছে, ফেরেন কয়েকজন বাংলাদেশিকে সঙ্গে নিয়ে৷
আমি কথা বলা শুরু করতেই চিনে ফেললেন৷ জানালেন, ডয়চে ভেলের সংবাদ নিয়মিত দেখেন তিনি৷ তবে, প্রচারবিমুখ মানসিকতা স্পষ্ট তার মধ্যে৷ কিছুটা কথা হতেই আবার ছোটেন সীমান্তের দিকে৷ কিছুটা পা টেনে টেনে হাঁটছিলেন, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ বোঝা যাচ্ছিল৷ টানা কয়েকদিনের পরিশ্রমে এই অবস্থা হয়েছে তার৷ এরই মধ্যে জানালেন, একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি৷
পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তের কাছে অবস্থান করা একমাত্র বাংলাদেশি কূটনীতিক অনির্বাণ নিয়োগী৷ ইউক্রেন থেকে সাহায্যের অসংখ্য বার্তা প্রতিনিয়ত তার কাছে আসছিল৷ কেউ কেউ সীমান্ত পার হতে গিয়ে আটকে যাচ্ছিলেন, কেননা, পাসপোর্ট বা প্রয়োজনীয় ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই৷ এমন বাংলাদেশিরাও চাচ্ছিলেন সীমান্ত পার হতে৷
আমি মেডিকাতে মঙ্গলবার থাকাকালেই একটি খবর শুনেছিলাম যে, অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশিকে আটকে রেখেছে পোল্যান্ডের বর্ডার পুলিশ৷ অনির্বাণ নিয়োগী তাদের ছাড়াতে আমার সামনেই নানা জায়গায় ফোন করেছেন, নানাভাবে তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন৷
সেদিন অবশ্য তাদের কাছে যেতে পারেননি তিনি৷ তবে পরের দুই দিনে এরকম আটক বেশ কয়েকজনকে মেডিকার পাশের শহর সেমিশেল থেকে উদ্ধার করেছেন তিনি৷ কাগজপত্রের ঘাটতি থাকা এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন তিনি, পোলিশ কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা বাংলাদেশি৷ এরকম নানাভাবে কয়েকশত বাংলাদেশিকে মেডিকা সীমান্ত থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশে সহায়তা করেছেন এই কূটনীতিক৷
বিপদের সময় দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে যে কাজটি করতে হয়, ঠিক সেটাই নিরলসভাবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে করছেন অনির্বাণ নিয়োগী৷ বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল তার মতো আরো কয়েকজনকে সীমান্ত এলাকায় পাঠানো৷ তিনি একা যতটা সম্ভব সামাল দিয়েছেন বটে, তবে সেটা যথেষ্ট ছিল না৷
কিছুক্ষেত্রে বাংলাদেশি শরণার্থীরা হয়ত কাঙ্খিত সহায়তা পাননি, কেননা, দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিকভাবে হয়নি বা যে সীমান্তে অনিবার্ণ নিয়োগী ছিলেন, সেই সীমান্তের বদলে অন্য সীমান্ত দিয়ে হয়ত বাংলাদেশিরা পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ বাংলাদেশ সরকার আরো লোকবল নিয়োগ করলে এই বিষয়টি এড়ানো যেতো৷ পাশাপাশি এখনো যারা ইউক্রেনে আটকে আছেন, তাদের উদ্ধারে সরকারের আরো দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার৷ লোকবলের ঘাটতি সেই বিষয়টিকেও পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে৷
এখানে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, অনিবার্ণ নিয়োগীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন একদল পোল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি৷ শুধুমাত্র দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাকরিবাকরি ভুলে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে দিনের পর দিন অবস্থান করছেন তারা৷ কখনো তীব্র শীতের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থেকে শরণার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন তারা, কখনোবা গাড়িতে করে তাদের পৌঁছে দিচ্ছেন কোনো নিরাপদ ঠিকানায়৷ অনেককে সাময়িক আশ্রয়ও দিচ্ছেন পোল্যান্ড প্রবাসীরা৷
বাংলাদেশিদের পাশে বাংলাদেশের কূটনীতিক, প্রবাসীদের এভাবে দাঁড়াতে দেখে ভালো লেগেছে৷ মনে হয়েছে চারদিকে অসংখ্য হতাশার মধ্যে এটা এক আশার আলো৷ এই আলোর পরিধি যত বাড়বে, ততই মঙ্গল৷