বই নিষিদ্ধকরণ নিয়ে বিতর্ক
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪৭৩ বছর বয়সি মার্কিন ভারততত্ত্ববিদ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মবিষয়ক ইতিহাসের অধ্যাপিকা ড. উইন্ডি ডোনিগারের লেখা বইটির শিরনাম – ‘‘দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি'', অর্থাৎ ‘হিন্দুদের এক বিকল্প ইতিহাস'৷ এই বইটি নিষিদ্ধকরণের দাবি নিয়ে ভারতের পেঙ্গুইন প্রকাশনা সংস্থা বিতর্ক ও মামলায় জডিয়ে পড়ে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের পৃষ্ঠপোষক ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন' নামে এক সামাজিক সংস্থার সঙ্গে৷ তাদের মতে, বইটিতে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করা হয়েছে৷ হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভুলভাবে৷ কাজেই বইটি আর ভারতে প্রকাশ করা যাবে না৷ শুধু তাই নয়, ভরতে প্রকাশিত সব বই বাজার থেকে তুলে নিতে হবে৷ এ অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল এবং সংস্থাগুলিও বইটি নিষিদ্ধকরণের সমর্থনে এগিয়ে আসে৷
অবশ্য এর বিপরীত মত প্রকাশ করেন বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ৷ এ নিয়ে বিতর্ক ভোট রাজনীতির আবহে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবার উপক্রম হলে, বইটির প্রকাশক পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া বইয়ের সবগুলো ‘কপি' বাজার থেকে তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতের বাইরে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নেয়৷ মুচলেকা দেয়, সারা বিশ্বের সব ধর্মের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল৷
আসলে পেঙ্গুইনকে মাথা নত করতে হয় ভারতীয় আইনের কাছে৷ ভারতীয় আইনে ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করলে কিংবা কোনো প্রকাশকের দৈহিক নিরাপত্তার আশঙ্কা থাকলে, তা ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে দেওয়ানি বিধির মধ্যে নয়৷
ধর্ম বিষয়ক বই লেখার সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পৃক্ত থাকে বলে সবসময়ই তা বিতর্কের জন্ম দেয়৷ এ কথা নতুন নয় এবং এমন বিতর্ক আগেও ঘটেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা?
এই ইস্যুতে ভারতীয় সমাজ বিভাজিত৷ ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পেঙ্গুইন প্রকাশনা সংস্থার উচিত ছিল উচ্চতর আদালতে আপীল করা৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশের মতে, ড. ডোনিগারের লেখার মধ্যে কিছু আপত্তিকর বক্তব্য থাকলেও, রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই৷ বরং ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন' নামে সংস্থাটি উক্ত বইটি নিষিদ্ধকরণের জন্য পেঙ্গুইন প্রকাশনার ওপর তালিবানি কায়দায় চাপ সৃষ্টি করেছে৷ এরা ভারতের উদার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চাইছে৷
রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ স্বপন দাসগুপ্ত মনে করেন, চিন্তন, মনন ও শিক্ষামূলক চর্চা সর্বদাই বিতর্কিত৷ সেটা ‘সেন্সারশিপ'-এর হাতকড়া পরিয়ে থামানো যায় না৷ বিরুদ্ধবাদীদের মতে, ডোনিগারের বইয়ে যেসব তথ্য ও বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বিকৃত মানসিকতা প্রতিফলন রয়েছে৷ প্রতীকী বিশ্লেষণও কদর্য৷ এছাড়া বইটি ভৌগলিক তথ্যগত ভুলভ্রান্তিতে ভরা, গোড়া ধর্মবাদীরা যা বরদাস্ত করতে রাজি নয়৷
এ বিষয়ে লেখিকা ড. ডোনিগারের বক্তব্য, ‘‘আমি হিন্দু ধর্মের পার্থিব জগত, যেমন সমাজ-সংসারে নারী, জাতপাতের ভেদাভেদ, পশুপ্রাণী ইত্যাদি আরো নানা জিনিস নিয়ে আলোচনা করেছি৷ এর মধ্যে আছে হিন্দু জাতির বিকল্প ইতিহাসের নানা রসদ৷ ভারতের মতো উদারমনস্ক সমাজে স্বাধীন মত প্রকাশের ধারা দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক বাতাবরণে৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক৷''
অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, সলমান রুশদির ‘‘স্যাটানিক ভার্সেস''-এর ওপর মুসলিম মৌলবাদীদের ফতোয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পেঙ্গুইন প্রকাশনা যে দৃষ্টান্তমূলক সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছিল, তাতে তারা এত তাড়াতাড়ি হার মানলো কেন? তাও এক ছোট মৌলবাদী সংস্থার কাছে? পক্ষান্তরে এটা ভারতে ইচ্ছামতো বই পড়ার অধিকার কেড়ে নেবার সমান নয় কী? তবে কী হিন্দুত্ববাদী বিজেপির কেন্দ্রে সরকার গঠনের সম্ভাবনা আছে বলে? আসলে স্পর্শকাতরতা এমনই সংক্রামক যে কোনো অপছন্দের লেখা নিয়ে তা নিষিদ্ধকরণের দাবি তোলা যায়, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, তাতে সোশ্যাল মিডিয়া এখন নিতে চলেছে নৈতিক পুলিশের ভূমিকা৷ সম্প্রতি এর চাপেই মহারাষ্ট্র সরকার নিষিদ্ধ করেন ‘‘শিবাজি: হিন্দু কিং ইন মুসলিম ইন্ডিয়া'' বইটি৷ আসলে সবই হয়ত কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায়৷
উল্লেখ্য, সলমান রুশদির ওপর এখনো ঝুলছে মৃত্যুর পরোয়ানা৷ বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন বহু বছর ধরে তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত, এপার-ওপার দুই বাংলার মুসলিম মৌলবাদীদের দাপটে৷ বলা বাহুল্য, এটা সুস্থ সমাজ চেতনার পরিপন্থি৷ তবে একথাও অনস্বীকার্য যে, ধর্ম মানুষের জীবনকে যেভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে তাতে একটা লক্ষণরেখা থাকা উচিত৷ এমনই মনে করেন সমাজবিদরা৷