হুমকির মুখে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য
১৬ এপ্রিল ২০১৮সুন্দরবনের মোংলা হাড়বাড়িয়া এলাকায় পশুর চ্যানেলে রবিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে কার্গো জাহাজ এম.ভি বিলাস সাড়ে সাতশ' টন কয়লাসহ ডুবে যায়৷ ওই কার্গো জাহাজটির হাড়বাড়িয়া-০৬ নম্বর অ্যাংকারেজে থাকা একটি বিদেশি জাহাজ থেকে কয়লা নিয়ে ঢাকার মিরপুরে যাওয়ার কথা ছিল৷
কয়লা বোঝাই জাহাজটি উদ্ধারে ঘটনাস্থলে দু'টি উদ্ধারকারী জাহাজ পৌঁছেছে৷ তবে মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার অলিউল্লাহ জানিয়েছেন, জাহাজটি টেনে তুলতে ৭-৮ দিন সময় লাগতে পারে৷
সোমবার দুপুরে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷ বাগেরহাট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ইমদাদুল হক জানান, ‘‘ঘটনাস্থলে ভাটার সময় পানির গভীরতা ছিল ১২ ফুট৷ সেখান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে৷ এটি খুলনা ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিস্তারিত জানা যাবে৷'' আর বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদ হাসান জানান, যত দ্রুত সম্ভব ডুবে যাওয়া কার্গোটি তুলে ফেলার জন্য সংশ্লিষ্টদের বনবিভাগের পক্ষ থেকে চাপ অব্যাহত রয়েছে৷ এই জাহাজডুবির ঘটনায় সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে তা নিরূপন করতে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বনবিভাগ৷''
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই কয়লার মধ্যে শিসা, ক্রোমিয়াম, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, অ্যালুমুনিয়ামসহ আরো অনেক ক্ষতিকর হেভিমেটাল আছে, যা দীর্ঘসময় ধরে প্রকৃতিতে থাকে৷ এটা দীর্ঘ সময় ধরে জলজ প্রাণী ও পরিবেশের ক্ষতি করে৷ আর জোয়ার-ভাটার পানির কারণে এটা বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে৷ আর যতটুকু জায়গায় যায় ওই এলাকার জলজ প্রাণী, মাছ প্রভৃতির জীবনচক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ কোনো কোনো প্রাণী মরে যায়৷ কোনোটির বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়৷ মাছ বা জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ আবার হয়তো মাছ ডিম পাড়ে, কিন্তু তা থেকে বাচ্চা ফোটে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আর পানি দূষিত হওয়ার কারণে পাশের বনের মাটিতেও এই রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে সুন্দরী, পশুর এবং ধুন্দলের মতো যেসব সংবেদশীল গাছ আছে, তাদের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্থ হয়৷ এই গাছগুলো বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে৷ তাদের ফল বা বীজ থেকে নতুন গাছ হচ্ছে না৷ বীজ পচে যায়৷''
গত ৪-৫ বছরে সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে ৭-৮ টি কয়লা ও জ্বালানি তেল বোঝাই জাহাজ ডুবেছে৷ এর আগে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন ডুবে যায়৷ ২০১৫ সালের ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবে যায় সার বোঝাই কার্গো জাহাজ এমবি জাবালে নূর৷
২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবতে-ডুবতে অন্য কার্গোর সহায়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরেকটি কয়লা বোঝাই কার্গো৷ ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর সুন্দরবনের পশুর নদীতে ৫১০ মেট্রিক টন কয়লাবাহী এমভি জিয়া রাজ কার্গো ডুবে যায়৷ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর ‘হরিণটানা' বন টহল ফাঁড়ির কাছে ১২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি সি হর্স-১' ডুবে যায়৷ ২০১৭ সালের ৪ জুন দিনগত রাতে হারবাড়িয়া চ্যানেলে ৮২৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালসহ ‘এমভি সেবা' নামে একটি কার্গো তলা ফেটে ডুবে যায়৷
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত চার বছরে এরকম ৮-১০টি জাহাজ সুন্দরবনের আশপাশে বা ভিতরের নদীতে ডুবেছে৷ তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুষণের কথা বাদই দিলাম, এই জাহাজগুলো উদ্ধারও করা হয় না৷ ফলে নাব্যতাও নষ্ট হচ্ছে৷ সার, তেল, কয়লাবাহী জাহাজ ডুবেছে৷ কিন্তু এর ফলে পরিবেশ, জলজ প্রাণী, পানি, জলজ সম্পদ এবং সুন্দরবনের কী পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করা হয়নি৷ কামিটির কথা আমরা শুনি, কিন্তু প্রতিকার দেখি না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে ইরাবতী ডলফিন এই দূষণের কারণে বিপর্যয়ের মুখে আছে৷ তারা হারিয়ে যাচ্ছে৷ মৎস সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে৷ আর সরাসরি সুন্দরবন ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌযান চলছে৷ কয়লার জাহাজ ডুবলে শুধু কয়লা নয়, ওই জাহাজের যে জ্বালানি থাকে তা-ও ছড়িয়ে পড়ে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷ কারণ, তখন প্রতিদিন গভীর সমুদ্রের মাদার ভেসেল থেকে প্রতিদিন ১০-১২টি লাইটারেজ জাহাজে করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এই কয়লা আনা হবে৷ তখন ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে৷''