শিশুমৃত্যু কার দোষে?
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫সোমবার রাত ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৭টা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডসহ তিন ওয়ার্ডে ১০ শিশু মারা যায়৷ তাদের মধ্যে পাঁচ নবজাতক ৷ সোমবার তাদের জন্ম হয়েছিল৷ বাকি পাঁচ শিশুর মধ্যে সর্বোচ্চ দেড় বছর বয়সি শিশু রয়েছে৷
মারা যাওয়া শিশুরা হলো: রাজশাহীর শেখঘাট এলাকার নিলুফার, শহরতলীর শাহ পরানের আসমা এবং একই এলাকার সন্ধ্যা রানীর নবজাতক; হবিগঞ্জের ইয়াসমিন (বয়স ৩ দিন) ; সিলেটের জকিগঞ্জের দশগ্রামের আকাশ (৭ দিন); সুনামগঞ্জ সদরের তাজরিয়া ও মেহেদি (আড়াই মাস), বিশ্বম্ভরপুরের নাদিয়া (৬ মাস), ছাতকের শাপরাজ (দেড় বছর) এবং সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সায়মা (দেড় বছর)৷
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আবদুস সালামের তথ্যমতে, ২৪ ঘন্টায় শিশুসহ ৩২ জন মারা গেছে৷ তাঁর মতে, প্রতিদিন গড়ে এই হাসপাতালে ১৪ জন মারা যায়৷ তবে ১০ ঘন্টায় ১০ শিশুর মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে জানান তিনি৷
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৫৬টি শয্যা আছে, কিন্তু ভর্তি আছে ১৬২ শিশু৷ নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও ঠান্ডাজনিত সমস্যায় শিশুদের সেখানে ভর্তি করা হয়৷
অভিভাবকদের অভিযোগ, চিকিত্সকদের অবহেলার কারণেই এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ সিলেট নগরের শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা অটোরিকশাচালক আবুল কালাম ও নিলুফা আক্তার দম্পতির প্রথম সন্তান মারা গেছে৷ রবিবার নিলুফা এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়৷ সোমবার শিশুটিকে শিশু ওয়ার্ডে নেয়া হয়৷ মঙ্গলবার সকালে শিশুটি মারা যায়৷ প্রথম সন্তানের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন নিলুফা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘কোনো রোগে না, অবহেলায় আমার বাচ্চা মারা গেছে৷''
তবে ডা. আব্দুস সালাম দাবি করেন, শিশুরা বিভিন্ন রোগে মারা গেছেন৷ তিনি আরো জানান, '‘চিকিত্সকদের অবহেলার বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখবে৷ শিশু মুত্যুর এ ঘটনায় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. ইসমাইল পাটোয়ারীকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে৷'’
এদিকে ঢাকায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, শিশু মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে৷ এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ একদিনে এতগুলো শিশুর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হবে৷ চিকিত্সকদের কোনো অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক অবশ্য দাবি করেন, ‘‘পাঁচ নবজাতক মারা গেছে জন্মকালীন শ্বাসরোধে৷ বাকি পাঁচ শিশু ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়াসহ অন্য সমস্যায় মারা গেছে৷ আর পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের মৃত্যু সম্পর্কে মহাপরিচালক বলেন, চোখের সমস্যা, হার্ট অ্যাটাক ও মারামারির ঘটনায় আহত পাঁচজন মারা গেছেন৷'
বাংলাদেশের চিকিত্সা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ আছে৷ হাসপাতালে সুযোগ সুবিধা না থাকা ছাড়াও চিকিত্সকদের হাসপাতাল ফেলে প্রাইভেট প্রাকটিস করা এর মধ্যে অন্যতম৷
বাংলাদেশে প্রতি দুই হাজার ৬৫৯ জনের বিপরীতে ডাক্তার মাত্র একজন৷ আর পাঁচ হাজার ২৩৫ জনের জন্য নার্সও মাত্র একজন৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে দেশে মোট সরকারি হাসপাতাল আছে ৫৭০টি৷ এর মধ্যে উপজেলা ও তার নিচের পর্যায়ে রয়েছে ৪৫৯টি৷ জেলা ও বিভাগ এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল মিলে রয়েছে ১১৯টি৷
প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে যথাক্রমে দুই হাজার ২৭১ ও চার হাজার ৭৩৫টি৷ সারা দেশে মোট প্রাইভেট চিকিত্সকের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ৷ এর মধ্যে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চিকিত্সক ও ডিগ্রিবিহীন চিকিত্সকের অনুপাত ১: ১২৷
এর বাইরে সারা দেশে ১৭ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে৷
বাংলাদেশের চিকিত্সকদের বিরুদ্ধে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পাশাপাশি কর ফঁকিরও অভিযোগ আছে৷
জাতীয় রাজস্ববোর্ডের অভিযোগ চিকিত্সকরা প্রাইভেট প্রাকটিস করলেও ৯০ শতাংশ চিকিত্সক তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দেন না ৷ তাই তাদের চিহ্নিত করে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর৷ এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত বেতন পাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসা ও প্রাইভেট প্রাকটিস থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন চিকিত্সকরা৷ কিন্তু বেশিরভাগ চিকিত্সক বেতনের বাইরে বাড়তি উপার্জনের ওপর কর দেন না৷ কর ফাঁকি দিতে তাঁরা আয়কর বিবরণীতে প্রকৃত উপার্জনের চেয়ে কম হিসাব দেখান৷ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ৬০ হাজার রেজিস্টার্ড চিকিত্সক রয়েছে৷ তবে এদের মধ্যে আয়কর দেন মাত্র ১০ হাজারের মতো চিকিত্সক৷ এছাড়া সারাদেশে বিপুল সংখ্যক নিবন্ধনহীন চিকিত্সক রয়েছেন যারা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে প্রচুর অর্থ আয় করেন৷
এনবিআর-এর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল এরই মধ্যে ৫৩৭ জন চিকিত্সকের তালিকা করে তাদের আয়কর সংক্রান্ত তথ্যাবলী সংগ্রহ ও প্রস্তুত করেছে৷ এদের কারও চার্জ বা ফি ৫০০ টাকার নীচে নয়৷ কারও কারও ফি হাজার টাকারও বেশি৷ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, নামি-দামি চিকিত্সকরা দৈনিক ৩০ থেকে ৮০ জন রোগী দেখেন৷