২০ জুলাই - নাৎসিবিরোধী জার্মান প্রতিরোধের মধ্যমণি স্টাউফেনব্যার্গ
২০ জুলাই ২০১১১৯৪৪ সালের এই দিনে সামরিক অফিসার কউন্ট ক্লাউস শেঙ্ক ফন স্টাউফেনব্যার্গ'কে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রতিরোধকারীদের একটি গ্রুপ হিটলারকে মারার জন্য বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু তা ব্যর্থ হয়৷ হিটলার প্রাণে বেঁচে যান৷ হত্যা করা হয় ষড়যন্ত্রকারীদের৷ স্টাউফেনব্যার্গ ছিলেন এই গ্রুপের মধ্যমণি৷ তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা জার্মানিকে হিটলারি বর্বরতার মাঝে তার পতন থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন৷
‘‘আমরা চাই এক নতুন ব্যবস্থা যা সকল জার্মানকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি করবে এবং তাদের জন্য অধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করবে৷ কাউন্ট ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ, জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯০৭৷'' দানিয়ুব নদীর দক্ষিণে উল্ম আর আউগসবুর্গ শহরের মাঝে ইয়েটিঙ্গেন দুর্গে এই স্মৃতিফলকটিই চোখে পড়বে দর্শনার্থীদের৷ এই দুর্গই স্টাউফেনব্যার্গ পরিবারের আদি বাসস্থান৷ স্টাউফেনব্যার্গের জন্ম এখানে৷ তিনি বাবামা'র তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম সন্তান৷ বাবা ছিলেন ভ্যুর্টেমব্যার্গ'এর রাজার সামরিক বাহিনীর অফিসার৷ পুত্রও সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
১৯ বছর বয়সে স্টাউফেনব্যার্গ অশ্বারোহী রেজিমেন্টে যোগ দেন৷ তারপর হ্যানোভারের ক্যাভালরি স্কুল এবং বার্লিনের রণকৌশল অ্যাকাডেমীতে প্রশিক্ষণ৷ সব সময়ই সেরা বলে বিবেচিত হয়েছেন৷ প্রাথমিক পর্বে নাৎসিবাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানিকে ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তি মেনে নিতে হয়েছিল৷ কিন্তু অধিকাংশ জার্মানের কাছে চুক্তির শর্ত ছিল অবমাননাকর৷ তাদের মত স্টাউফেনব্যার্গও মনে করেছিলেন, এই চুক্তি রদ করতে হবে৷ আর হিটলার সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ১৯৩৮ সালে গোটা জার্মানিতে যখন ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগ পুড়তে শুরু করল, ইহুদিদের উপর দমন আর পীড়ন জোরদার হল, তখনই স্টাউফেনব্যার্গ'এর ভাবনায় পরিবর্তন আসতে থাকে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে কাজ করেছেন স্টাউফেনব্যার্গ ফ্রান্স, পোল্যান্ড আর রাশিয়ায়৷ তারপর ফ্রন্টে বদলির আবেদন করেন৷ পূর্ব রণাঙ্গনে নিহত ইহুদিদের দেহ দেখে বিচলিত হন তিনি৷ মনে মনে তিনি হয়ে ওঠেন প্রবলভাবে হিটলার বিরোধী৷ কিন্তু তখনও তাঁর গায়ে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম৷ মিলিটারি সার্ভিসে ঢোকার সময় উচ্চারিত শপথবাক্যের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ৷
আফ্রিকায় এক অপারেশনের সময় একটি চোখ এবং ডান হাতটি হারান স্টাউফেনব্যার্গ৷ এর পর তাঁকে দেয়া হয় অফিসে বসে কাজ করার দায়িত্ব৷ হিটলারের প্রধান দপ্তরে প্রবেশাধিকার পান তিনি৷ তাঁর মনে এই প্রতীতি জন্মায় যে জার্মানিকে বাঁচাতে হলে হিটলারকে মরতেই হবে৷ তাঁর গোপন পরিকল্পনার নাম হয় ভালক্যুরে৷
বেসামরিক এক প্রতিরোধ গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে মিলে স্টাউফেনব্যার্গ হিটলারকে মেরে ফেলার প্রস্তুতি নেন৷ ২০ জুলাই ১৯৪৪৷ একনায়ক হিটলারের প্রধান দপ্তরে বোমা পেতে রাখেন তিনি নিজে৷ বিস্ফোরণ হয় যখন, তখন তিনি বিমানে বার্লিনের পথে৷ তিনি মনে করেছিলেন হিটলার ইতিমধ্যেই মৃত৷ কিন্তু তিনি যে বেঁচে গেছেন তা তিনি জানতেন না তখনও৷ হিটলার বেতারে ভাষণ দিয়ে জানিয়ে দেন যে তিনি জীবিত৷
কী ঘটছে তা না জেনেই স্টাউফেনব্যার্গ তাঁর অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান৷ কিন্তু তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীদের কাছ থেকে কোন সাড়া মেলে না৷ সেই রাতেই হিটলার অনুগতরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে৷ অন্যন্য প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে তাঁকেও গুলি করে হত্যা করা হয় বার্লিনের সেই ভবনের চত্বরে - আজ যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অবস্থিত৷
স্টাউফেনব্যার্গ নিহত হবার পর রেহাই পান নি তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ বাবামা, সহোদর ভাই, নিকট জনদের হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয় নয়তো মেরে ফেলা হয়৷ স্টাউফেনব্যার্গ'এর মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ দেহভস্ম ছড়িয়ে দেয়া হয় বাতাসে৷
প্রতিবেদন: রিশার্ড ফুখ্স/আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন