২৪ ধরনের মাদক সেবন চলে বাংলাদেশে
১৯ জুন ২০১৮মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী অবশ্য দেশে ২৪ নয়, ১৫ রকমের মাদক সেবন করা হয়৷তবে র্যাব-পুলিশের হিসেবে সংখ্যাটা ৬ থেকে ১০-এর মধ্যে৷ এই মাদকগুলো কোন সীমান্ত দিয়ে আসছে, কীভাবে আসছে? সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে৷
দেশে মাদকসেবীরা যেসব মাদক সেবন করেন, সেগুলোর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম৷ মাদক চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে নতুন মাদকসেবীরা জানতে পারছে নতুন নতুন মাদকের নাম৷ মাদক ব্যবসায়ীদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগ্রেপ্তার করলেও মাদকসেবীদের গ্রেপ্তারে তাদের আগ্রহ কম৷ কারাগারেও তাদের নিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে৷ মাদকসেবীদের অস্বাভাবিক আচরণে অতীষ্ঠ হন কারারক্ষীরাও৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে৷ আর এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন৷
তবে সংখ্যায় এত হলেও আসলে বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক৷সবচেয়ে ভয়াবহতা ইয়াবাকে ঘিরে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সবখানেই মিলছে ইয়াবা৷ যদিও সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর অনেকটা গোপনে বিক্রি হচ্ছে মাদক৷ পুলিশের অভিযানের কিছুক্ষণ পরই নতুন করে বিক্রিতে লেগে যাচ্ছেন মাদক ব্যবসায়ীরা৷ মাদকের বড় ব্যবসায়ীদের কেউ ধরা পড়েনি৷ অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ বিদেশ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মাদক ব্যবসা৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের অভিযানে ১৫ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে৷ তবে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা আর ফেনসিডিলই বেশি৷ অন্যগুলো পরিমাণে খুব বেশি পাওয়া যায় না৷ তবে সাম্প্রতিককালে ইয়াবা বেড়ে যাওয়ায় অন্য মাদক পরিমাণে কম পাওয়া যাচ্ছিল৷ এখন অভিযান শুরুর পর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ আমরা উৎস বন্ধ করার চেষ্টা করছি৷ ইয়াবাটা শুধু মিয়ানমার থেকেই আসে৷ আর অন্য মাদকগুলো আসে ভারত থেকে৷’’ চোলাই মদ এখানেই তৈরি হয়৷ আর গাঁজার কিছু চাষ গোপনে বাংলাদেশে হয় বলেও স্বীকার করেন জনাব চৌধুরী৷
আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস) এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান)-এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ৷ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে এদেশে মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটছে৷ তিন দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার৷ দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে৷ মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)৷ সম্প্রতি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে৷
অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে৷ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর কত টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এর সুনিদিষ্ট কোনো হিসেব কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এক হিসেবে দেখা গেছে, সারা দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ২৫ লাখের কম নয়৷ ৫ শতাধিক মদকাসক্তের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে তাদের ১৫০ টাকার মাদক লাগে৷ এই হিসেবে একজন মদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকার মাদক সেবন করে৷ ২৫ লাখ মাদকাসক্ত বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার মাদক সেবন করে৷ এসব মাদকের পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে আসছে৷ আর পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা৷’’
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে আসলে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক আমরা অভিযানে গিয়ে উদ্ধার করি৷ এর বাইরেও হয়ত অনেক ধরনের মাদক আছে, সেটা খুব একটা পাওয়া যায় না৷ ইয়াবাটা শুধু মিয়ানমার থেকে জলপথে প্রবেশ করে৷ আর অন্য সব মাদক ভারত থেকে সীমান্ত পথেই দেশে আসে৷ সম্প্রতি আমাদের অভিযান শুরুর পর মাদকের উৎস অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে৷ তবে এটা তো একদিনে নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ মাদকবিরোধী র্যাবের এই অভিযান অব্যহত থাকবে৷’’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, তাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদাহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরে মাদক ঢুকছে৷ আর ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায়৷’’
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং ফেনীতে৷ এছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেন্সিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এ সব রুট দিয়ে দেশে হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাঁজা ঠেকাতে বাংলাদেশের আহ্বানে ভারত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ফেন্সিডিল ও ফেন্সিডিল তৈরির উপকরণ সরবরাহ এবং বহন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত৷
তবে মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কারণ, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি-কোটি পিস ইয়াবা৷ ইয়াবার অবাধ প্রবেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশে৷ বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান এবং কাচিন প্রদেশে৷ মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মুয়াংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের গুনদুম, নাইখ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আসলে ইয়াবার জন্য মিয়ানমারের পছন্দের বাজার ছিল থাইল্যান্ড৷ কিন্তু এরপর আমাদের দেশে এই মাদকের আসক্তের সংখ্যা কল্পনার বাইরে চলে যাওয়ায় ইয়াবার বড় বাজারে পরিণত হয় বাংলাদেশ৷ এই বাজারের চাহিদা মেটাতে কক্সবাজার-টেকনাফের স্থল সীমান্তবর্তী ৬০-৭০টি স্পট দিয়ে দেশে ইয়াবা ঢুকছে৷ কক্সবাজার, টেকনাফ সংলগ্ন উপকূলবর্তী সমুদ্রে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি ছোট-বড় নৌযান চলাচল করে৷ এসব নৌযানে করে ইয়াবার চালান আসে৷ মাদক অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে এসব রুট দিয়ে আসা ৪ কোটি ৭৯ হাজার পিস ইয়াবা, ৪০১ কেজি হেরোইন, ৭ লাখ ২০ হাজার বোতলের বেশি ফেনসিডিল এবং ৬৯ হাজার ৯৮৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়৷ বলা হয়, যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয় তা মোট ব্যবহারের ১০ ভাগের কম৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ে একাধিক বৈঠকে মাদক পাচাররোধে নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়৷ ওইসব বৈঠকের তথ্যমতে, বৃহত্তর যশোর সীমান্তে ৫২টি এবং উত্তরাঞ্চলের ৬ জেলার ৭২ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৭০টি ফেনসিডিল, ১০টি হেরোইন প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার তালিকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ-এর হাতে তুলে দেয়া হয়৷ একাধিক বৈঠকে কারখানাগুলো দ্রুত বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানানোর পর মাত্র এক ডজন বন্ধ করে বিএসএফ৷ অন্যান্য কারখানা বন্ধের তাগাদা দিচ্ছে বাংলাদেশ৷’’
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেলী ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ যে অভিযানগুলো চালায়, সেখানে ৫-৬ ধরনের মাদক পাওয়া যায়৷ সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পাওয়া যায় ইয়াবা, যা শুধু মিয়ানমার থেকেই আসে৷ আর ভারত থেকে আসে ফেনসিডিল, গাঁজা আর হেরোইন৷ হেরোইনটা মূলত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়েই বেশি আসে৷ আর ফেনসিডিল আসে সব সীমান্ত দিয়েই৷’’
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান, লিখুন নীচের ঘরে৷