কখনো আমরা মানসিকভাবে আহত হই, কখনো উপেক্ষা করি, কখনো বা কিছুক্ষণ খারাপ লাগা থাকে।
প্রতিক্রিয়া যদি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে এই লেখারই কোনো দরকার হত না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তত মানুষের মধ্যে এই অনুভূতিতে আঘাত লাগার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। তাতে আঘাত লাগলে তার পরিণতি ভয়ংকর হচ্ছে। এই অনুভূতির কথা বলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নানান বিধিনিষেধ। এমনকি মানুষকে হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। অনুভূতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অসহিষ্ণুতা, মিশে যাচ্ছে রাজনীতি, মিশে যাচ্ছে আরো অনেক কিছু।
একটা ছোট উদাহরণ দিই। উত্তর ভারতে নবরাত্রির উদযাপন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় একটা বড় অংশের মানুষ নিরামিষ খান। কিন্তু তখন এই উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমিষ বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ, ওই সময় আমিষ দেখলে যারা নবরাত্রি উদযাপন করেন তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অথচ, বছর দশ-পনেরো আগেও পরিস্থিতি এরকম ছিল না। তখনো নবরাত্রি হত, আমিষ বিক্রিও হত। কিন্তু এখন সময় বদলেছে, তার সঙ্গে অনুভূতিও। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে অনুভূতিতে আঘাত লাগার ঘটনা গত কয়েক বছর ধরে প্রবল হয়েছে।
এই খাবার প্রসঙ্গে আরো একটা অনুভূতির কথা বলতে হয়। উত্তরপ্রদেশের দিল্লিঘেঁষা নয়ডায় মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল এই অভিযোগে, তার বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস রাখা আছে। আর এর ফলে অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। পরে অভিযোগ ওঠে, গোমাংস রাখাটা ছিল নিছক রটনা।
কখনো কোনো বই, কোনো নাটক, কোনো সিনেমা বা কোনো মানুষের কথায় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বই, নাটক, সিনেমা নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। দাবি ওঠে, ওই মানুষ বা মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার।
কিছুদিন আগে একটা সিনেমা এসেছিল, প্রথমে তার নাম ছিল পদ্মাবতী, পরে তা বদলে পদ্মাবত করা হয়। রাজস্থানের রাজপুতরা তখন অভিযোগ করেন, ওই সিনেমা তাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। সিনেমার কিছুটা বদলাতে হয়। এটা নিছক একটা উদাহরণ হিসাবে দিলাম। না হলে, সব এলাকায়, সব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে হইচই এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
ক্রমশ এর পরিধি বাড়ছে, ক্রমশ এর প্রতিক্রিয়া বাড়ছে, ক্রমশ এর মধ্যে ঢুকে পড়ছে আরো নানা বিষয়। এমনকী তা দেশের সীমান্তও পেরিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের উপমহাদেশে মানুষের মনের ভিতরে ঢুকে গেছে ফর্সা-কালোর ধারণা। সেটা মাঝেমধ্যে খুবই খারাপভাবে বেআব্রু হয়ে যায়। সাহিত্য, নাটকে এমন একটা ভাব দেখানো হয়, ফর্সা হলেই ভালো দেখতে, কালো হলেই তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করা হয়। এক তো এটা বর্ণবিদ্বেষের ঘটনা। তাছাড়া এতেও তো অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অথচ, এই নিয়ে কেউ কথা বলে না। কেউ বেশি মোটা হলে বা বেশি রোগা হলেও বডি শেমিংয়ের মুখে পড়তে হয়। তাতেও তো অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অথচ, এই অনুভূতি নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ ভাবিত নয়।
আসলে ধারণার বদল না হলে খুব মুসকিল। অন্যের অনুভূতি বোঝাটাও জরুরি। না হলে এই আঘাত লাগতেই থাকবে। আর আঘাত লাগলে তার প্রতিক্রিয়া হবে। এই চক্র থেকে বের হওয়া যাবে না। ফলে শুধু অনুভূতির বদলই নয়, মনেরও বদল হওয়াটাও জরুরি।