ভয়ের এক নতুন সংস্কৃতি
২৪ জুলাই ২০১৭আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন ৯৭ জন৷ এর মধ্যে ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ২৬ জনকে৷ পরিবারের কাছে ফেরত এসেছেন তিনজন৷ ২০১৫ সালে অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন ৫৫ জন৷
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের একটি প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যে জানা যায়, এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই ৫৭ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এদের মধ্যে ছ'জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে৷ শুরুতে অস্বীকার করলেও ২৫ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বা আদালতে বিভিন্ন মামলায় সোপর্দ করা হয়েছে৷ বাকি ২৬ জনের এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷
তবে আইনি দিক থেকে অপহরণের চেয়ে গুমের ব্যাপারটাকেই বেশি জটিল বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷ তিনি বলছেন, ‘‘গুম শব্দটার মধ্যেই এক ধরনের অস্পষ্টতা, ঝাপসা একটা ব্যাপার কিন্তু লুকিয়ে আছে৷ অর্থাৎ এমন কেউ নিয়ে যাচ্ছেন বলে আপনি-আমি ধারণা করছি, অথচ আইনগতভাবে এটার কোনো জায়গায় কোনো প্রতিকার চাওয়ার বা পাওয়ার কোন সুযোগ থাকছে না৷''
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করতে চায় না৷ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন এক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলেও তৈরি হয় জটিলতা, ‘‘কোর্ট বলছে, আমরা কাকে ডিরেকশন দেবো? তারা তো বলছে তারা নেয়নি৷ যদি না নিয়ে থাকে, আপনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে তাদের কাস্টডিতে আছে?''
দীর্ঘদিন ধরে এই আইনি সংকটের কথা উঠে আসলেও, জটিলতা নিরসনে নতুন আইন বা আইনের নতুন ব্যাখ্যা তৈরিতে নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ৷ আদালতেও একাধিক ক্ষেত্রে এই ধরনের কেসস্টাডি আসলেও, কখনও দেয়া হয়নি কোনো নির্দেশনা৷
‘‘পুলিশ বা অন্য যে কোনো বাহিনী যে কাউকে জোর করে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে, এটার আইনী স্বীকৃতি যতদিন তৈরি করা না যাবে, ততদিন এর বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা নেই'', মনে করছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷
একদিকে ভয়ভীতি, অন্যদিকে আইনি জটিলতা৷ এর ফলে কিছুদিন গুম থাকার পর যারা ফিরে আসছেন, তারাও মুখ খুলছেন না কারও সামনে৷ এমনকি যাদের মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে তাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকছেন হুমকির মুখে৷
‘‘বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভে, যেখানে আপনাকে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া না মেনে গায়ের জোরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, সেখানে কেউ ফিরে এসে মুখ খুলবে আশা করাটা আসলে আমাদের জন্য অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে'', এমনটাই মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷
তবে ‘আইন নেই' বা ‘ঘাটতি আছে', এমন কথা মানতে একেবারেই নারাজ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিন খসরু৷
তিনি বলেন, ‘‘কোনো মানুষ গুম হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা৷ আইন সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যেতেই পারে৷ কিন্তু এই বিষয়ে আইনের কোনো ঘাটতি নাই৷'' প্রচলিত আইনেই গুমের বিচার করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷গুম হয়ে ফেরত আসার পর, কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না৷ এ বিষয়টি সরকারকে নানাভাবে জানানো হয়েছে বলে জানালেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক৷
কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের এই ভূমিকায় কি কোনো লাভ হচ্ছে? সরাসরি হ্যাঁ বা না বললেও কাজী রিয়াজুলের বক্তব্যে ঠিকই মিলল উত্তর, ‘‘কে তাদেরকে অপহরণ করেছিল, কে তাদের তুলে নিয়েছিল, তারা কি সাধারণ মানুষ, নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ, সেগুলো আমরা এখনও জানার চেষ্টা করছি৷''
আইনে গুম বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ নেই, সেটি মানছেন মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানও৷ অতীতে অপহরণ হলেও এখন তার ধরন বদলেছে, ফলে আইনেরও রিফর্ম বা সংশোধন দরকার বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘আমরাও আমাদের পক্ষ থেকে রিসার্চ করতে পারি৷ গুম তো শুধু বাংলাদেশে ঘটছে না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঘটছে, অতএব তারা কীভাবে এটাকে ‘হ্যান্ডেল' করছে, এ বিষয়টা আমরা এতটা গুরুত্বের সাথে দেখিনি৷''
কাজী রিয়াজুল হক বলেন, জনবল সংকটের কারণে মানবাধিকার কমিশন চাইলেও অনেক সময় নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তথ্য নিয়ে আসতে পারে না৷ সবসময় সঠিক তথ্যউপাত্ত না থাকায় বিভিন্ন ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করতেও সমস্যায় পড়তে হয় মানবাধিকার কমিশনকে৷
গুমের বিষয়টি স্পষ্ট ব্যাখ্যাসহ আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে যারা ফিরে আসছেন, তারাও সাহসের সঙ্গে এর মোকাবেলা করতে পারতেন বলেও মনে করেন কাজী রিয়াজুল হক৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷