1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অপহরণের তদন্তে আগ্রহ নেই

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৪ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে গত সাড়ে তিন বছরে ২৮৪ জন অপহরণের শিকার বা নিখোঁজ হন৷ এঁদের বড় অংশই আর ফিরে আসেনি৷ যাঁরা এসেছেন বা যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁরা অপহরণ নিয়ে কিছু বলছেন না৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তদন্তে আগ্রহী নয়৷

https://p.dw.com/p/2h0HT
Rapid Action Battalion RAB Spezialeinheit Militär Dhaka Bangladesh
ছবি: Getty Images/AFP

ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার ১৬ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার হয়েছেন৷ উদ্ধার হওয়ার পর তিনি পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন৷ আর জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ভোরে ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হলে মাইক্রোবাসে করে দুর্বৃত্তরা তাঁকে অপহরণ করে৷ তবে পুলিশ এখন এটাকে অপহরণ মানতে নারাজ৷ তারা বলছে, ‘‘এটা সরকারকে বিব্রত করতে একটি সাজানো ঘটনা৷'' এই ‘অপহরণ' ঘটনার বেশ জোরেশোরে তদন্ত করছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ৷ শেষ পর্যন্ত উলটে ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে মামলা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷

কিন্তু পুলিশ কি সব ঘটনার তদন্ত করে? যাঁরা অপহরণের পর ফিরে আসেন, তাঁরা কেন কথা বলেন না?  ফিরে আসার পর অপহরণের ঘটনা তদন্ত করলে অনেক রহস্যই তো বেরিয়ে আসতে পারে৷ পুলিশ সেই তদন্তে কেন জোর দেয় না? 

Masudur Rahman - MP3-Stereo

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন৷ তাঁদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জন ব্যক্তির৷ নিখোঁজের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন৷ তবে এখনও ১৭৭ জনের কী অবস্থা তা জানা যাচ্ছে না৷ তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা পরিবার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বলতে পারছেন না৷

আসক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে অনেককেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকেও অপহরণের অভিযোগ আছে৷ আর প্রতিটি অপহরণ বা নিখোঁজের ঘটনার পরই পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাঁদের কোনো উত্তর দিতে পারে না৷

গত বছরের ১৬ মার্চ অপহৃত হন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা৷ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার তদন্তের নানা দিক নিয়ে গণমাধ্যমে মতামত দেওয়ার পর তাঁকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়৷

সাত দিন পর তাঁকে এয়ারপোর্ট রোড এলাকায় পাওয়া যায়৷ তিনি সেখানে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছিলেন৷ জোহা ফিরে আসার পর এই বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি৷ তাঁর পরিবারের সদস্যরা কথা বললেও তাতে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই৷ তবে গত ১৯ জুলাই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ জোহা জানান, ‘‘আমাকে আটকের পর মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয়৷ এরপর আমাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে তার কিছুই আমি বুঝতে পারিনি৷ আমাকে কতদিন আটক রাখা হয়েছিল তা-ও আমি বুঝতে পারিনি৷ উদ্ধার হওয়ার পর পরিবারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে আমাকে যে প্রথমেই ইনজেকশন পুশ করা হয়েছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি৷ যারা আমাকে মাইক্রোবাসে তুলেছিল আদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি৷ আমি শুরুতে জানতে চেয়েছিলাম – তোমরা কারা? তারা কোনো জবাব দেয়নি৷'' 

Rehana Banu - MP3-Stereo

গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওনা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ফিরে আসার পরও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি৷ আর পুলিশও এটা নিয়ে কোনো তদন্ত করেনি৷

লক্ষীপুরের চিকিৎসক মুহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ গত বছরের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এ দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায় আসেন৷ এরপর বাড়ি গিয়ে ১৫ অক্টোবর রাতে রাজধানীতে ফেরার সময় সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে তিনি অপহৃত হন৷ ঘটনার সাড়ে সাত মাস পর এ বছরের ১ জুন চোখ বাঁধা অবস্থায় লক্ষীপুরে তাঁকেও ফেলে যায় অপহরণকারীরা৷ বিষয়টি ধানমন্ডি থানা পুলিশের পাশাপাশি লক্ষীপুর থানা পুলিশও তদন্ত করেছে৷ তিনিও অপহরণের বিষয়ে মুখ খোলেননি৷ ফিরে আসার পর পরিবার ও সাংবাদিকদের ডাক্তার ইকবাল মাহমুদ জানান, তাঁকে তিন বেলা খেতে দিতো নিয়মিত৷ এমনকি নামাজের সময়ও দিত৷ তবে নির্যাতন করেনি৷ তাঁকে অপহরণের রহস্যও উদঘাটন করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ইকবালের বাবা নুরুল আলম বলেন, ‘‘আমার ছেলে কোনো কিছুই বলতে পারে না৷ ঘটনার পর আমরা দৌড়াদৌড়ি করেছি৷ সবার সহযোগিতায় তাকে ফিরে পেয়েছি৷ ইকবাল এখন মোটামুটি ভালো আছে৷ চলাফেরা করছে৷''

চিকিৎসক ইকবালের অপহরণ মামলাটি সর্বশেষ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করে৷ সিআইডি-র সহকারি পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথ মামলাটি তদন্ত করেন৷ ইকবাল উদ্ধার হওয়ার পর এই তদন্ত কর্মকর্তাই ইকবালকে আদালতে নিয়ে যান এবং তিনি আদালতে জবানবন্দি দেন৷ এরপর তাঁর পরিবারের সঙ্গে পুলিশ আর যোগাযোগ করেনি৷ মামলারও কোনো অগ্রগতি  নেই৷ 

সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তুলে নেয়া হয়৷ তিনি পল্লবীতে তাঁর আরেক ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ সেখান থেকে অস্ত্রধারীরা তুলে নেয়৷ তাঁর বড় বোন রেহানা বানু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাকে সরকারি সংস্থার লোক পরিচয়ে বাসা থেকে বের করে মাইক্রেবাসে তুলে নেয়া হয়৷ সাত থেকে আটজন সশস্ত্র ব্যক্তি নিজেদের সরকারি সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়৷  তারা সময়ও দেয়নি৷ মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার ভাইকে নিয়ে যায়৷ কিন্তু এরপর পুলিশ, ডিবি র‌্যাবে যোগাযোগ করলে কেউই তাকে নেয়ার কথা স্বীকার করেনি৷ আমরা থানায় গেলে পুলিশ দুই দিন ঘুরিয়ে জিডি নেয়৷ ২০১৫ সালে মামলা নেয়৷''

তিনি জানান, ‘‘মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে৷ আর তাতে বলা হয়েছে, তাকে তুলে নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু কারা বা কেন তুলে নিয়েছে তা জানা যায়নি৷ ভবিষ্যতে জানা গেলে আবার তদন্ত হবে৷''

রেহানা আরো জানান, ‘‘আমরা আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি৷ কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না৷ পুলিশের মধ্যেও কোনো চেষ্টা দেখছি না৷''

Sheik Hafizur Rahman Karzon - MP3-Stereo

অপহরণের কিছু ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন একুশে টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি দীপু সরওয়ার৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, সহজে তথ্য পাওয়া যায় না৷ যাঁরা অপহৃত হন, তাঁদের পরিবারও যেমন কোনো তথ্য দেয় না, আবার তদন্তকারী পুলিশও কোনো তথ্য দিতে চায় না৷ আর যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁরা মুখ বন্ধ রাখেন৷ ফলে কোনো ঘটনা  সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও অপরাধীদের সরাসরি চিহ্নিত করা যায় না৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা অভিযোগ পাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তুলে নেয়া হয়েছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেটা নিয়ে পরে আর কাজ করার তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না৷ অনেক ঘটনাই বলতে গেলে সূত্রবিহীন৷''

ঢাকা মেট্রাপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য অপহরণে জড়িত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হয়৷ তবে কোনো অপরাধীচক্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করতে পারে৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কেউ নিজে আত্মগোপনে চলে যান৷ আবার পারিবারিক কারণেও নিখোঁজ এবং অপহরণের ঘটনা ঘটতে পারে৷ এসব ক্ষেত্রে অপহরণের পর পরিবারের সদস্যরা তথ্য গোপন রাখেন, আবার ফিরে আসার পরও তথ্য প্রকাশ করতে চায় না৷ ফলে তদন্তে অনেক সময়ই অনেক তথ্য জানা যায় না৷'' 

Tanvir Hasab Zoha - MP3-Stereo

নিখোঁজদের কেউ কেউ আবার পাঁচ-ছ'মাস পরে গ্রেপ্তারও হন৷ এ প্রসঙ্গে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘অপরাধীরা পালিয়ে থাকে৷ তাদের পরিবার মনে করে নিখোঁজ৷ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে যখন খুঁজে পায় তখন৷''

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নাই৷ নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ রাষ্ট্র এবং সরকারকেই দিতে হবে৷ এটা রাষ্ট্রের আইন ও সাংবিধানিক দায়িত্ব৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘ব্যক্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যদি রাষ্ট্র দিতে না পারে, সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা৷''

সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও অপরহরণ এবং গুমের শিকার হচ্ছেন৷ তাঁদের মধ্যে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী, সালাহ উদ্দিন আহমেদের নাম উল্লেখযোগ্য৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷