অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল: শাস্তির ভয় থাকছে না
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫২০১৪ সাল কি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হবে, নাকি উন্নতির পথে মোড় নেবার বছর হিসেবে গণ্য করা হবে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল-এর (এআই) মহাপরিচালক সলিল শেট্টি এ বছরের রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ এআই-এর মতে, সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বর্তমান সংকটের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ অনেক কষ্ট করে যে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি প্রক্রিয়া গড়ে তোলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা তার আওতা থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে৷ নিজেদের দেশেও তাদের শাস্তির সম্ভাবনা কমে চলেছে৷ ফলে আরও বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক ‘শাস্তিহীন পরিবেশ' ছড়িয়ে পড়ছে৷ রিপোর্ট অনুযায়ী এ বিষয়ে রাষ্ট্রগুলির প্রতিক্রিয়া ‘একেবারেই পর্যাপ্ত নয় এবং অত্যন্ত লজ্জাজনক'৷
ভয়ংকর চিত্র
অ্যামনেস্টির বাৎসরিক রিপোর্ট সত্যি ভয়ংকর৷ দামেস্ক থেকে কাবুল, মেক্সিকো থেকে বাকু, দক্ষিণ সুদানের জুবা থেকে পিয়ংইয়ং বা কলম্বো, আবুজা থেকে মস্কো তথা মধ্য এশিয়া – এমনকি ওয়াশিংটন থেকে বেইজিং-এরও উল্লেখ রয়েছে তাতে৷ এই সব জায়গায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে৷ অথবা সামরিক সংঘাতের সময় বেসামরিক জনগণের সুরক্ষায় জেনিভা কনভেনশন অমান্য করা হয়েছে৷ এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে মানবিক সাহায্য সরবরাহের কাজ আরও কঠিন করা হয়েছে৷ নাগরিক সমাজের যে সব প্রতিনিধি অন্যায়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে তার নিন্দা করার সাহস দেখিয়েছেন, তাদের মুখ বন্ধ করতে আরও আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং তাদের উপর স্বৈরাচারী নিপীড়ন আরও বাড়ছে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কূটনৈতিক আবহের মধ্যে যাঁরা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের প্রতি চীন, রাশিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো দেশের বৈরি আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা এআই রিপোর্টের সুর অবশ্যই বুঝতে পারবেন৷
ইউরোপের ‘পিছিয়ে পড়ার বছর'
শুধু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রক্তাক্ত সংঘাত এবং মত প্রকাশের অধিকার ও সমকামীদের অধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়ার নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নয়, জার্মানি সহ ইউরোপেরও স্বস্তির কারণ নেই৷ একদিকে আছে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য, অন্যদিকে বেড়ে চলা আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসীদের প্রতি মানবিক আচরণ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে৷ ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশের সরকারি দল যখন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের দিকে লক্ষ্য করে তোপ দাগতে থাকে, তখন দেশ-মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে এ যুগের এক দুঃখজনক প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে যায়৷ তারা ‘মানুষের নিরাপত্তা
'-র স্বার্থে মৌলিক স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করতে আগ্রহী৷ জাতিসংঘের নিপীড়ন-বিরোধী সনদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিপীড়ন হলো ‘বলপূর্বক বয়ান আদায় করতে কোনো মানুষের উপর সচেতন অত্যাচার'৷ কিছু মতলবি আইনজীবী তার ব্যাখ্যা বদলে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন৷ মার্কিন সেনেটের রিপোর্ট শুধু সিআইএ-র ভয়ংকর আচরণ তুলে ধরেনি, সে ক্ষেত্রে ইউরোপের সহযোগিতার মাত্রাও স্পষ্ট করে দিয়েছে৷
আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকট
রুয়ান্ডায় গণহত্যার ২০ বছর পরেও আফ্রিকা মহাদেশ অসংখ্য রক্তাক্ত সংকটে বিপর্যস্ত রয়েছে৷ আন্তর্জাতিক সংহতি ও সহায়তায় দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে বটে, কিন্তু চরম দারিদ্র্য সে দেশকে সংকটে ছেয়ে রেখেছে৷ জাতিসংঘের নাকের ডগায় সে দেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার নারী ও শিশু সহ দরিদ্রতম ও অসহায় মানুষের দুর্দশা সত্ত্বেও রক্তাক্ত জাতিগত সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে৷ ২০১১ সালে আরব উপদ্বীপের ‘বসন্ত' বেশ কিছুকাল ধরে শীতের কবলে চলে গেছে৷ আজ লিবিয়া ও ইয়েমেন রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে পড়ার পথে৷ স্বঘোষিত ও মানবতাবিরোধী খিলাফতের সামনে ইরাকের অবস্থা টলমল৷ সন্ত্রাসবাদী চরম ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মিশরে আবার এক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা দানা বাঁধছে৷ সিরিয়ার রক্তাক্ত সংগ্রামে ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ জাতিসংঘ মৃতের সংখ্যা গোনা ছেড়ে দিয়েছে৷ মানুষ এই সংকটের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে৷ ইসরায়েল ও গাজা সংকটে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আলোচনা বহুকাল থেমে রয়েছে৷ ইসরায়েল তার নিরাপত্তার স্বার্থ দেখিয়ে চলেছে৷ সে দেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে নারাজ৷ এর মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে ইসরায়েল তার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করে নিয়ম লঙ্ঘন করছে৷
ভেটো প্রয়োগ না করাই কি পথ?
বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঁধে রয়েছে৷ সেইসঙ্গে মানবাধিকারকে সম্মান দেওয়া ও তা কার্যকর করার দায়িত্বও রয়েছে৷ অ্যামনেস্টির রিপোর্ট জুড়ে একদিকে সংকট ও স্থিতিশীলতার অভাব, অন্যদিকে সাম্যের অভাব, দারিদ্র্য ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অজস্র উল্লেখ রয়েছে৷ অ্যামনেস্টির দাবি অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যদি এই প্রেক্ষাপটে তাদের ভেটো শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে, তাহলে কি কোনো কাজ হবে? ১৯৯৩ সাল থেকে এই পরিষদের সংস্কার নিয়ে ধীর গতিতে আলোচনা চলছে৷ ফলাফলের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না৷ অর্থাৎ এর পরিণতি কী হবে, কেউ তা জানে না৷ করুণ মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে প্ররোচনা ও সাবধানবাণী – অর্থাৎ ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে উন্নতির আশা৷ জার্মানিও সেই সুযোগ পাবে৷ ২০১৫ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করছে জার্মানি৷