ইয়াবা কারবারিরা করবে ‘মাদক নির্মূল'
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তারা আমাদের অনেক তথ্য দিয়েছেন৷ আরো তথ্য তারা দেবেন বলে আশা করি৷ যা ইয়াবা নির্মূলে কাজে লাগবে৷''
কক্সবাজারের টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য শাহিন আক্তার এবং পুলিশের আইজির উপস্থিতে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি ও চোরাচলানি আত্মসমর্পণ করেন শনিবার৷ এর আগে তারা জেলা পুলিশের সেফ হোমে ছিলেন৷ যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের মধ্যে ৩৫ জন ইয়াবা গডফাদার রয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে৷ ৫৭ জন বড় ইয়াবা কারবারি৷
আত্মসমর্পণকারীরা সাড়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা এবং ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্রও জমা দিয়েছে৷ এই ১০২ জনের বিরুদ্ধে শনিবার ইয়াবা এবং আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য মোট ২টি মামলা হয়েছে৷ ওই দু'টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের সবাইকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷
ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ভাইসহ তার ২৬ জন আত্মীয় স্বজন থাকলে থাকলেও তাদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছেন মাত্র চারজন৷
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসাইন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা আত্মমর্পণ করেছেন তাদের সঙ্গে আমাদের কয়েকটি চুক্তি হয়েছে৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী শনিবার যে দু'টি মামলা হয়েছে এই দু'টি মামলায় সরকার সহযোগিতা করবে৷ তারা যাতে এই দু'টি মামলা থেকে সহজে অব্যাহতি পেতে পারে সেই আইনগত সহায়তা করবে সরকার৷ তবে তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে আগের মাদক বা ইয়াবা মামলা আছে সেগুলোর বিরুদ্ধে তাদের নিজেদেরই আইনি লড়াই চালিয়ে মুক্ত হতে হবে৷ আর যারা আইনের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও পুনর্বাসনে সব ধরণের সহায়তা করবে সরকার৷ আর যদি কেউ আবার মাদক ব্যবসায় ফিরে যায় তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘স্বাভাবিক জীবনে যারা ফিরবেন তাদের সামাজিকীকরণ এবং সমাজে যাতে সবাই তাদের গ্রহণ করেন সে ধরনের সামাজিক উদ্যোগও নেয়া হবে৷''
আত্মসমর্পণকারী এই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সেফহোমে থাকার সময় পুলিশকে ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপারে অনেক তথ্য দিয়েছে৷ তালিকার বাইরেও ২২০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম জেনেছে পুলিশ, যাদের আগে কেউ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে জানতো না৷ তারা ইয়াবা পাচারের রুট এবং ব্যবসার কৌশল সম্পর্কেও জানিয়েছেন৷
পুলিশ সুপার জানান, ‘‘আমরা চাই, এই আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন আমাদের ইয়াবা ও মাদক নির্মূলে সহায়তা করুক৷ তাদের সহায়তায় আমরা ইয়বার বিরুদ্ধে আরো বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করতে চাই৷ তারা বাইরে বের হয়ে আসার পর আমরা তাদের নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করব৷ আর যে সময় তারা কারাগারে থাকবেন তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে আরো তথ্য জানার চেষ্টা করব৷''
তিনি জানান, ‘‘এরা আমাদের ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন৷ নতুন অনেকের কথা বলেছেন তাদের নাম তালিকায় নেই৷ আমরা এখন সেই সব তথ্য যাচাই বাছাইয়ের কাজ করছি৷ তথ্যগুলো যাচাই বাছাই শেষে কক্সবাজার এলাকায় ইয়রাবার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করব৷''
জানা গেছে, এরইমধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আরো উচু পর্যায়ের নিয়ন্ত্রকদের নাম পাওয়া গেছে৷ যা আগে পুলিশের অজানা ছিল৷ ৩০ জন এজেন্টের নাম জানা গেছে, যারা অর্থ লেনদেন এবং হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা পাচারে সহায়তা করে৷
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের এই আত্মসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার মধ্যেও কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই৷ আত্মসমর্পণের আগের দিন শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে কক্সবাজারের ইনানী, নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফ সীমান্ত থেকে র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা ৫ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে৷ এছাড়া বিজিবি নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে চার লাখ ৪০ হাজার ও টেকনাফ থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে৷ তবে তারা কোনো পাচারকারিকে আটক করতে পারেনি৷
জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘এজন্য শুধু অভিযান ও গ্রেপ্তারই যথেষ্ট নয়৷ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ কারণ প্রচুর ইয়াবাসেবী আছেন৷ চাহিদা থাকলে এর চোরাচালান বন্ধ করা কঠিন৷''
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণে নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেছেন বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ২৪-এর চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার মীর মো. আকরাম হোসাইন৷ তিনি শনিবার টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷
আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কথা বলেছেন সেখানে উপস্থিত তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে৷ আকরাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান৷ তারা ইয়াবা নির্মূলে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করতে চান৷ তাদের আত্মীয়স্বজন চান, তারা যেন আর ইয়াবা ব্যবসায় ফিরে না যায়৷ তারা যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন৷ এতদিন তাদের স্বজনদের মধ্যে উৎকন্ঠা ছিল৷ সেই উৎকন্ঠার অবসান হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে কক্সবাজার এলকায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷ সাধারণ মানুষ মনে করেন এই ধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ইয়াবা নির্মূল হয়ে যাবে৷ তবে অভিযান, গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণই শুধু নয়, ইয়াবা নির্মূলে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন৷''
এদিকে, যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ তারা জানিয়েছেন, আত্মসমর্পণের পর এখন কী হবে সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই৷ আত্মমর্পণকারী একজন মো. জোবাইর হোসেনের বাবা মো. ওসমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি জানিনা এখন কী হবে৷ বদির কথায় আত্মসমর্পণ করেছে৷ আমি আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম৷ পারি নাই৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘আমি মাছের ব্যবসা করি৷ আমার ছেলেও আমার সঙ্গে মাছের ব্যবসা করত৷ তবে তার বিরুদ্ধে একাধিক ইয়াবার মামলা আছে৷''
আত্মসমর্পণকারী ইউপি সদস্য রেজাউল করিম রেজার ভাই মোহাম্মদ ফরিদ অবশ্য এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহী নন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি জানিনা আমার ভাই কেন আত্মসমর্পণ করেছে৷''
কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে আলোচিত নাম উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি৷ বিতর্কের কারণেই গত ৩০ ডিসম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি৷ তার জায়গায় তার স্ত্রী শাহিন আক্তার মনোনয়ন পান এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ কিন্তু বদি ওই আত্মমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না৷ তবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তার থাকার কথা শোনা গিয়েছিল৷
প্রসঙ্গত, গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফের এক হাজার ১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম আসে৷ তার মধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারী বা পৃষ্ঠপোষকের নাম আছে৷ তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্য রয়েছে৷ এতে তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের সম্পদের তথ্যও রয়েছে৷