উদ্বাস্তু সংকট আজ ইউরোপের সংকট
১৪ আগস্ট ২০১৭ইইউ-এর ডাবলিন নীতি অনুযায়ী উদ্বাস্তুরা প্রথম যে শেঙেন চুক্তির দেশে পা দেবেন, সেখানেই তাঁদের নথিভুক্ত করা হবে ও সেখানেই তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন পেশ করবেন৷ বাস্তবে গ্রিস বা ইটালির মতো দেশ উদ্বাস্তুদের অংশত কোনোরকম শনাক্তকরণ ছাড়াই উত্তরমুখে যেতে দিয়ে থাকে৷ উদ্বাস্তুদের অধিকাংশের লক্ষ্য স্বভাবতই জার্মানি, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, কোনো বেনেলুক্স দেশ বা ফিনল্যান্ড৷
ইউরোপে পৌঁছানো উদ্বাস্তুদের সুদীর্ঘ যাত্রার প্রথম পর্ব৷ ইউরোপে পা দেবার পর ঈপ্সিত দেশে যাত্রা ও প্রবেশের প্রচেষ্টা হলো এই ‘অভিবাসনের' দ্বিতীয় পর্যায়৷ উভয়ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বাস্তু নীতির সঙ্গে পরিচয় ঘটছে অভিবাসনপ্রয়াসীদের৷ অভিবাসনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ঈপ্সিত দেশে পৌঁছে, সেখানে নাম লিখিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা দেবার পর৷ এবার উদ্বাস্তুরা মুখোমুখি হন ইইউ-এর নয়, বরং সংশ্লিষ্ট দেশটির নিয়মকানুন, আমলাতন্ত্র, ব্যবস্থাপনা, আইন-আদালত ও বহিষ্কারের ক্ষেত্রে পুলিশি কড়াকড়ির সঙ্গে৷
কোঁদল ও দঙ্গল
উদ্বাস্তু সংকটকে কেন্দ্র করে ইউরোপের ধারণাটিতেই ভাঙণ ধরার লক্ষণ দেখছেন অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা৷ উদাহরণস্বরূপ পূর্ব ইউরোপের তথাকথিত ভিসেগ্রাদ দেশগুলি – অর্থাৎ চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া – উদ্বাস্তু নীতির ক্ষেত্রে ইইউ-এর পূর্বের সদস্যদেশগুলি ক্রমেই পশ্চিম থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে ও তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে৷ লৌহ যবনিকার ওপারের দেশগুলি বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে, সেখানে বিদেশি-বহিরাগতদের সংখ্যা কম; কাজেই তাদের বহিরাগত ভীতি সেই অনুপাতে বেশি৷ দ্বিতীয়ত, এই দেশগুলি ও তাদের নাগরিকরা সদ্য কয়েক দশক হল নিজেরা সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছেন ও সুদিনের মুখ দেখছেন; এটা তাদের জাতীয় জীবনে একটা নতুন পর্যায়, যখন রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সব কিছু তাদের নতুন করে ঢেলে সাজাতে হচ্ছে৷ এই মুহূর্তে উদ্বাস্তুদের গ্রহণ ও পুনর্বাসনের মতো দায়িত্ব তারা ঘাড়ে করতে চাইছেন না৷
অপরদিকে নিজেদের সমৃদ্ধি, সুখ-স্বচ্ছলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা হারানোর (কাল্পনিক অথবা দক্ষিণপন্থি প্রচারণার ফলে ধূমায়মান) ভীতি তো শুধু একা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেই নয় – জার্মানির পূর্বাঞ্চলও আজ ৩০ বছর হয়নি, কমিউনিস্ট শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে৷ কাজেই জার্মানির পুবের রাজ্যগুলিতে এএফডি-র মতো দক্ষিণপন্থি দল সেই একই বহিরাগত-বিদ্বেষের ফসল কুড়োচ্ছে, যে ফসলের কল্যাণে হাঙ্গেরির ভিক্টর অর্বান, পোল্যান্ডের ইয়ারোস্লাভ কাচিনস্কি বা স্লোভাকিয়ার রবার্ট ফিকো-র মতো নেতা করে খাচ্ছেন৷
উদ্বাস্তু সংকটের মোকাবিলার জন্য চাই একটি ইউরোপীয় নীতি – সেটা সকলেই জানেন৷ অথচ ঠিক সেই যৌথ বা সাধারণ নীতিটাই এই বিশেষ সমস্যাটির ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ বোধহয় রাজনীতিকরাও এই মহাসত্যটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি যে, আর্থিক সংকট তবুও অর্থ সংক্রান্ত সংকট, উদ্বাস্তু সংকট কিন্তু মানুষ নিয়ে; বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ভাষার ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের আসন-বসন-পুনর্বাসন ও সহাবস্থান নিয়ে৷ উদ্বাস্তু সমস্যা হলো মানুষ নিয়ে সমস্যা৷ এই সমস্যাটাই আবার আদিগন্তকাল ধরে নিজেই নিজের সমাধান: বাসের জায়গা যখন আর বাসযোগ্য থাকে না, তখন মানুষ খেতে পাক আর না পাক, বাস তুলে অন্য গাঁয়ে, ভিনদেশে যাত্রা করে – প্রস্তরযুগ কিংবা তারো আগে থেকে মানুষ – এবং পশুপাখি – যা করে এসেছে৷ ‘মাইগ্রেশান' শুনলে পক্ষি- কিংবা প্রাণীবিশারদ, সেই সঙ্গে নৃতত্ত্ববিদরাও হাসেন: ও ছাড়া নাকি প্রকৃতি বা মানবসভ্যতা, দু'টোর কোনোটাই বেশিদিন টিকতো না৷ ওটা আবার ‘ইউরোপীয়' সমস্যা হলো কবে?
অর্থ আর মানুষের তফাৎটা বোঝানোর আরেক পন্থা হল, ইউরোপীয় আর্থিক সংকট ও উদ্বাস্তু সংকটের ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকাটা বিবেচনা করা৷ আর্থিক সংকটের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিচারে ইউরোপের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ জার্মানি স্বভাবতই নেতৃত্ব দিয়েছে; সেই অর্থনৈতিক শক্তি আর সমৃদ্ধিই আবার উদ্বাস্তুদের কাছে জার্মানিকে অভীপ্স গন্তব্য করে তুলেছে, যার ফলে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা পড়েছে সবচেয়ে বেশি; যার ফলে জার্মানিকেই এখন অন্যান্য ইইউ-সহযোগীদের কাছে উদ্বাস্তু নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হচ্ছে৷
ত্রিধারা, নাকি ত্রহস্পর্শ?
ইইউ তথা ইইউ-এর দেশগুলির উদ্বাস্তু নীতির একটি অভ্যন্তরীণ, একটি সীমান্ত সংলগ্ন ও একটি বহির্মুখি উপাদান আছে৷ সীমান্ত সংলগ্ন উপাদানটির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো, ইইউ-এর বহির্সীমান্ত সুরক্ষিত করা, যাতে উদ্বাস্তুরা ইউরোপে আসতে না পারেন: এক্ষেত্রে তুরস্ক বা লিবিয়া প্রমুখ দেশগুলির উপর উদ্বাস্তুদের রোখার দায়িত্ব চাপানোটা অনেকটা আউটসোর্সিং-এর পর্যায়ে পড়ে, বলেন দুর্মুখরা৷ উদ্বাস্তু নীতির বহির্মুখি উপাদান হলো সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকার দেশগুলিকে উন্নয়ন সাহায্য দিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে উদ্বাস্তুরা ইউরোপে আসতে না চান৷ উদ্বাস্তু নীতির অভ্যন্তরীণ উপাদান, অর্থাৎ যে সব উদ্বাস্তু ইউরোপে এসে পড়েছেন, ইইউ-এর অভ্যন্তরে তাদের নিয়ে টানাপোড়েনের কাহিনি সুবিদিত ও মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে৷ এই অভ্যন্তরীণ উপাদানটি আবার গিয়ে শেষ হচ্ছে বহির্মুখি উপাদানে, কেননা ইউরোপ থেকে প্রত্যাখ্যাত উদ্বাস্তুদের তাদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠানোর জন্য সেই সব দেশগুলির সহযোগিতার প্রয়োজন৷
খর বায়ু বয় বেগে
উদ্বাস্তু সংকটের ফলে ইউরোপ জুড়ে জাতীয়তাবাদী ও দক্ষিণপন্থিদের পালে হাওয়া লেগেছে৷ ফলে প্রতিষ্ঠিত দলগুলিও এই নতুন ‘পপুলিজম'-এর চাপে পড়ে তাদের রং না হলেও, ঢং বদলাচ্ছে: ব্রিটেন একক অপ্রাপ্তবয়স্ক উদ্বাস্তুদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি বন্ধ করছে; জার্মানি অস্ট্রিয়া সীমান্তে নিয়ন্ত্রণের মেয়াদ বাড়াচ্ছে ও কী করে প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আরো তাড়াতাড়ি দেশে ফেরৎ পাঠানো যায়, তার পন্থা খুঁজছে৷ ইটালি লিবিয়ার উপকূলের ১২ মাইল জোনের মধ্যে ঢুকে মানুষপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে চায়৷ ওলন্দাজ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বিদেশি-বহিরাগতদের বলছেন, হয় আমাদের মতো হও, নয়ত দূর হও৷ অস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি, ফ্রান্সে ফ্রঁ নাসিওনাল বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট, জার্মানির এএফডি, এ সব দক্ষিণপন্থি দল আজ হয় সংসদে, নয়ত সংসদে ঢুকতে চলেছে৷ এরা সবাই ইইউ সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ পোষণ করে থাকে – খোলাখুলিভাবে ব্রেক্সিট অনুরূপ গণভোটের কথাও বলছে অনেকে৷ আর সবার উপরে ট্রাম্প সত্য, তাহার উপরে নাই৷ উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে যদি ব্রিটিশ মুলুকে ব্রেক্সিট সমর্থকদের জয় আর মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সে যে আরো কী করতে পারে, কে বলবে?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷