কতিপয় ‘প্রভাবশালীর আশ্রয়’ হয়ে ভাবমূর্তির সংকটের মুখে পিজি
২৮ জুলাই ২০২২পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান এসএসকেএম বা পিজি হাসপাতাল৷ এটিকে রাজ্যের সেরা হাসপাতাল মনে করেন অনেকে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এই হাসপাতালের মর্যাদাহানি হয়েছে বলে অভিযোগ৷ প্রশ্ন উঠেছে, চিকিৎসা পরিষেবা এভাবে রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া কি ঠিক? এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে?
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা অতীতে কেন্দ্রীয় সংস্থার তলব পেয়ে বা গ্রেফতারির পর সরাসরি ভর্তি হয়েছেন এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে৷ তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র, প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম, প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় থেকে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল— এমন বেশ কিছু নাম রয়েছে এই তালিকায়৷ এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিতর্ক তাই আবার মাথাচাড়া দিয়েছে৷
নিয়োগ মামলার শুনানিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিবেক চৌধুরী মন্তব্য করেন, হাসপাতাল ‘প্রভাবশালীদের নিরাপদ স্থান' হয়ে উঠছে৷ রায়ে তিনি লেখেন, শাসক দলের নেতারা তলব পেয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ও জিজ্ঞাসাবাদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন৷ তাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সরাসরি ভর্তি না করে শারীরিক পরীক্ষা করানোর কথা বলেছে আদালত৷ সেজন্য রাজ্যের মন্ত্রীকে ভর্তি হতে হয় কার্ডিওলজি বিভাগে৷ কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (এইমস)-এ মন্ত্রীকে পরীক্ষার পর বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে৷
পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পরীক্ষার পর যে রিপোর্ট এইমস থেকে পাওয়া গেছে, তা মিলে যাচ্ছে পিজি-র রিপোর্টের সঙ্গে৷ প্রশ্ন উঠেছে, যে রিপোর্টের ভিত্তিতে এইমস মন্ত্রীকে ভর্তি করানোর প্রয়োজন নেই বলে জানালো, একই ধরনের রিপোর্টে কেন পার্থকে ভর্তি রাখার কথা বললো এসএসকেএম? বিরোধীদের অভিযোগ- এটাই প্রমাণ করে চিকিৎসকরা রাজ্য সরকারের চাপের মুখে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একের পর এক নেতা গ্রেফতারির ভয়ে সরাসরি হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন৷ দিনের পর দিন সেখানে কাটাচ্ছেন৷ এভাবে কতদিন চলবে?'' পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মনে করেন, এ ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে এসএসকেএম-এর মতো প্রথম সারির হাসপাতালে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে৷
যদিও খোদমুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসএসকেএম হাসপাতালের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷পার্থ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, ‘‘আমার লজ্জা লাগছিল৷ বলে কিনা ওড়িশায় এইমস-এ নিয়ে যেতে হবে৷ সারা ভারতে পিজি এক নম্বরে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের যেখানে ছোঁয়া আছে, সেখানে নিয়ে যেতে হবে!'' একইভাবে সওয়াল করেছেন শাসক দলের অন্যান্য নেতারা৷ কিন্তু চিকিৎসক মহলে এ নিয়ে প্রশ্ন দানা বেঁধেছে৷ সাধারণ মানুষের কৌতূহল, তা হলে কি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তির শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট বদলে ফেলা যায়? চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে হাসপাতালে রাখা যায় দিনের পর দিন?
কলকাতার শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও সিইও কুণাল সরকারের বক্তব্য, ‘‘পিজি একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র৷ এখানে অসংখ্য মানুষের চিকিৎসা হয়৷ কিন্তু কয়েকজন নেতা লুকোনোর জন্য এই হাসপাতালের অপব্যবহার করছে৷ এবার প্রশ্ন উঠবে, চিকিৎসকরা রাজনৈতিক দলের কথায় কাজ করছেন৷ বস্তুত এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে৷ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, চিকিৎসকদের মধ্যে থেকেই৷''
সার্ভিস ডক্টর ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘ধর্ম-বর্ণ-আর্থিক অবস্থা কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় অনুযায়ী চিকিৎসা করা মেডিক্যাল এথিক্সের বিরোধী৷ চিকিৎসকদের একাংশ চাকরির পোস্টিং ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার লোভে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কাজ করছেন৷ অধিকাংশ চিকিৎসক অবশ্য এর সঙ্গে জড়িত নন৷'' তাঁর আশঙ্কা, ‘‘এর ফলে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে৷ এই অনিয়মের প্রভাব শুধু চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা সমাজে পড়বে৷''