কাতারের যুদ্ধবিহীন বিশ্বজয় বনাম শ্রমিক অধিকার
৩০ আগস্ট ২০২০২০২০ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হয় জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ এবং ফ্রান্সের পিএসজি৷ ফাইনাল ম্যাচের বল মাঠে গড়ানোর আগেই অবশ্য নিশ্চিত হয়ে যায় বিজয়ী হচ্ছে কাতারই৷ এমনকি এই ফাইনালকে কাতারের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ক্লাসিকো-ও (Qlasico) বলা শুরু হয়৷
এক দশক আগে ফ্রান্সের ক্লাব পিএসজির অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেয় কাতার৷ এবং এরপর থেকে ক্লাবটি ফ্রান্সের শীর্ষ লিগের অন্যতম সেরা দলে পরিণত হয়৷ ২০১৭ সালের পর থেকে কাতার এয়ারওয়েজের মতো রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা বায়ার্ন মিউনিখের মতো বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবে বিনিয়োগ শুরু করে৷
ফলে ইউরোপের সেরাদের লড়াইয়ে ফাইনালটা যখন পিএসজি আর বায়ার্নের মধ্যে হয়, জয়ী আসলে বলা যায় কাতারকেই৷ এ নিয়ে কোনো রাখঢাকও করতে রাজি নয় কাতার৷
গত শতকের ৯০ এর দশক থেকেই কাতার খেলাধুলার মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে৷ পিএসজিতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ছাড়াও ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্যই ব্যাপক যোগাযোগ চালিয়ে সফল হয় দেশটি৷
জার্মানির কনরাড আডেনয়্যার ফাউন্ডেশন টু গালফ স্টেটসের প্রতিনিধি ফাবিয়ান ব্লুমবার্গ বলেন, ‘‘খেলাধুলা এবং বিজ্ঞানের কৌশলগত বিনিয়োগ কাতারকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷ দুটোই একদিকে কাতারের ক্ষমতাও বাড়াচ্ছে, বহির্বিশ্বে কাতারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করছে৷’’
ভবিষ্যতের নিরাপত্তা
কাতারের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই নির্ভরশীল বিদেশি শ্রমিক, বিদেশি জ্ঞান এবং তেল বিক্রির ওপর৷ ফলে কাতারের ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত, তা দেশটির সরকারও ভালোভাবেই জানে৷ একই সঙ্গে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে শত্রুতা, বিশেষ করে শক্তিশালী সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধ দেশটির ভবিষ্যত আরো অনিশ্চয়তার দিকে ফেলে দিয়েছে৷
ব্লুমবার্গ জানান, ‘‘মাত্র ২৩ লাখ বাসিন্দা আছে ছোট দেশটিতে৷ এর মধ্যে ৯০ শতাংশই অভিবাসী৷ ২০১৭ সাল থেকে দেশটিকে বলতে গেলে একঘরে করে দিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো৷ ফলে কাতারের এখন ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা প্রয়োজন৷’’
এসব নানা কারণে ১৯৯০ এর দশকের দিকেই পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝোঁকার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে দেশটি৷ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি কাতারেই৷ আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের একটি দলকেও জায়গা করে দেয়া হয়েছে৷ ফলে প্রতিবেশি যেকোনো দেশের আগ্রাসন ঠেকাতে এই ঘাঁটিগুলো এক ধরনের নিরাপত্তা হিসেবেও কাজ করে৷
মানবাধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন
আধুনিক একটি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সব ধরনের চেষ্টার মধ্যেও দেশটির মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো কাতারেও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক মাহাম জাভাইদ বলেন, ‘‘কোনো কোনো সময় তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে নিজেদের ঘরের বিষয়ে তাদের খেয়াল থাকে না৷''
অনেক বছর ধরে কাতারের শ্রমিকদের কাফালা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন৷ কাফালা ব্যবস্থায় শ্রমিকদের জীবন কেমন হবে, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও ছেড়ে দেয়া হয় মালিকদের ওপর৷ আর এর সুযোগ নিয়ে অনেক মালিক তাদের শোষণ করেন৷
জাভাইদ বলেন, ‘‘কাফালার ফলে শ্রমিকদের মনে এতটাই ভয় কাজ করে যে তারা নিজেদের অধিকার বিষয়ে কথাও বলতে পারেন না৷ আর এর ফলে মালিকেরা মনে করেন শ্রমিকদের অধিকার বলতে কিছু নেই৷''
এরই মধ্যে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে অনেক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়ছে৷ কিন্তু বাস্তবেই তা শ্রমিকদের কতটুকু কাজে লাগছে, সে বিষয়ে সন্দিহান মানবাধিকার কর্মীরা৷
জাভাইদ মনে করেন, ‘‘যতদিন পর্যন্ত এই কাফালা ব্যবস্থা বাতিল না হচ্ছে ততদিন শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না৷’’
২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ দেশটিকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নতুন এক রূপে উপস্থাপন করবে৷ কিন্তু স্টেডিয়াম নির্মাণ থেকে শুরু করে পুরো আয়োজনটার পেছনে শ্রম দিয়ে কাতার সরকারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করেছেন যে অভিবাসী শ্রমিকেরা, তাদের অধিকার নিশ্চিত না হলে বিশ্ববাসীর মন জয় কতটুকু সম্ভব হবে?
লুইস স্যান্ডার্স/এডিকে