‘ক্রসফায়ারের’ উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কবে?
৩ আগস্ট ২০২০রোববার সেই কমিটি পূণর্গঠন করে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে নেতৃত্বে আনা হয়৷ অর্থাৎ কমিটিকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে৷
এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন তাহলে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনাগুলোর উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কেন করা হয়নি? সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিহত হওয়ার পরই কেন এই ধরনের কমিটি? তাহলে এতদিন যারা ‘ক্রসফায়ারে' মারা গেছেন তারা কি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না? জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন আইন সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন সবার জন্য সমান বলা হলেও আসলে তা নয়৷ আমরা তো অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, গত ১০ বছরে যারা বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সেই সবগুলো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷ আমরা তো মনে করেছিলাম, কাউন্সিলর একরামুল হকের ঘটনার পর ‘ক্রসফায়ার’ থামবে৷ কিন্তু সেটা হয়নি৷ বরং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আমরা ক্রসফায়ারের প্রতিযোগিতা হতে দেখেছি৷’’
সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যাওয়ার পর কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে শামলাপুরের পাহাড়ি এলাকায় ‘রোহিঙ্গা ডাকাত দল' হাকিম বাহিনীর আস্তানায় ‘সশস্ত্র লোকজনের আনাগোনা’ দেখে পুলিশে খবর দেয় স্থানীয়রা৷ তারা জানায়, ওই পাহাড়ি এলাকা থেকে বোরকা পরিহিত দুই লোককে নেমে এসে একটি প্রাইভেট কার নিয়ে মেরিন ড্রাইভের দিকে যেতে দেখেছে তারা৷ একটি গাড়ি চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় তল্লাশির জন্য সেটি থামায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা৷ ওই গাড়ির দুই জনের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর হিসেবে পরিচয় দিয়ে তল্লাশিতে বাধা দেন৷ এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তারা তর্ক-বিতর্কে জড়ায়৷ এক পর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ওই ব্যক্তি পিস্তল বের করে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করার চেষ্টা চালায়৷ আত্মরক্ষার্থে পুলিশ তখন গুলি ছোড়ে৷ এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে মারা যান৷
পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, পুলিশ ওই গাড়ি তল্লাশি করে জার্মানিতে তৈরি একটি পিস্তল, নয়টি গুলি, ৫০টি ইয়াবা, দুটি বিদেশি মদের বোতল এবং চার পোটলা গাঁজা উদ্ধার করেছে৷ ওই গাড়িতে থাকা অন্যকজনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়েরের কথাও জানান পুলিশ সুপার৷
এই ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়৷ সংশ্লিষ্টরা জানান, সিনহা মো. রাশেদ একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন৷ সেখানে তারা চারজন ছিলেন৷ রাতের ঘটনার পর পুলিশ ওই রিসোর্টেও অভিযান চালায়৷
এই ক্রসফায়ারের ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারি একটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন৷ তার বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপিং ডয়চে ভেলের হাতেও এসেছে৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘একটি প্রাইভেট কার থেকে একজন নামার পর বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলী তাকে গুলি করেছেন সেটা তিনি দেখেছেন৷’’
এই ঘটনার পর বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জসহ ২০ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ পুলিশ সুপার বলেছেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ ২০ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
এই ঘটনার পর কেন উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি হলো? এতদিন কেন সেটা হয়নি? জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক খন্দকার গোলাম ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে ফলে এখন আর কিছু বলা ঠিক হবে না৷ তাই তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলতে চাই না৷'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোববারই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশটি পেয়েছি৷ কমিটিতে সদস্য মনোনয়নের জন্য সোমবার কক্সবাজারের জিওসি ও পুলিশের ডিআইজিকে চিঠি পাঠিয়েছি৷ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় কক্সবাজারের সার্কিট হাউজে কমিটির একটি মিটিং ডেকেছি৷’’এই তদন্তে আগের ঘটনাগুলো আসবে কি-না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার তদন্ত করতে বলা হয়েছে৷ তবে তদন্তের প্রয়োজনে যদি আগের কোন ঘটনা আসে তাহলে সেটাও আমরা দেখবো৷’’
এই তদন্ত কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের একজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে৷ যাকে মনোনীত করবেন সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডার৷ পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির মনোনীত একজন প্রতিনিধি৷ এছাড়া কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলিকেও এই তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে৷ তাকে শুরুতে এই কমিটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছিল৷
কক্সবাজারের একজন প্রবীন সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৮ সালের ৪ মে থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারে ক্রসফায়ারে ২৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে ১৬৯ জন, বিজিবির গুলিতে ৬০ জন ও র্যাবের গুলিতে ৫১ জন মারা গেছেন৷ এই ধরনের বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড কেউই সমর্থন করেন না৷ তারপরও যখন কোন মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠে তখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী একটু শিথিল হয়৷ তখন আবার ইয়াবা ব্যবসায়িরা সক্রিয় হয়ে উঠেন৷ ফলে মাদক নিয়ন্ত্রণের একটা গ্রহণযোগ্য পথ খোঁজা দরকার৷’’
টেকনাফ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ ইকবাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত দুই বছরে ক্রসফায়ারে যারা মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে৷ তবে কয়েকজন নিরিহ মানুষও মারা গেছেন৷ এই ধরনের মৃত্যু কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়৷ আসলে এভাবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়৷’’
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিছুদিন পরপর এমন একটা ক্রসফায়ার নিয়ে বিতর্ক হয় তারপর সবকিছু থেমে যায়৷ আসলে মাদকের গডফাদার সাবেক একজন সংসদ সদস্যের নাম সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও এক নম্বরে৷ তার পরিবারের ২১ জন আত্মস্বীকৃত মাদক ব্যবসায়ী৷ তারা আত্মসমর্পনও করেছেন৷ আসলে তাকে আইনের আওতায় আনা গেলে ৯০ ভাগ মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে৷ তা না হলে কিছুদিন পরপর আমরা ক্রসফায়ার দেখবো৷ তাতে কিছু খারাপ মানুষের পাশাপাশি ভালো মানুষও মারা যাবে৷ এতে মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে না৷’’
২০১৫ সালের একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ডিসি-এসপির সামনে আমি বলেছি, আপনাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাঁচ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করলে ২ হাজার দেখায়৷ বাকীগুলো বিক্রি করে দেয়৷ এসব আগে বন্ধ হওয়া উচিৎ৷’’
২০১৫ সালের ছবিঘরটি দেখুন...