‘ক্রিকেট জাতিকে এক করে'
২০ মার্চ ২০১৭ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশ শততম টেস্টটি খেললো, জিতলোও৷ প্রথম টেস্টের অধিনায়ক ছিলেন আপনি৷ তা সেটা কতটা গর্বের ব্যাপার ছিল?
নাঈমুর রহমান দুর্জয়: এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা মাইলফলক৷ প্রথম টেস্টে অধিনায়কত্ব করা যে সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ কারণ এটা ইতিহাসে থাকবে৷ সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, এ জন্য যে সে সময় আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম৷ সেই সঙ্গে আরাকটা জিনিস ছিল – ভারতীয় টিমের অধিনায়ক ছিলেন পশ্চিমবাংলার৷ তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি৷ ফলে দু'পার থেকে দু'জন ক্যাপ্টেনই বাঙালি ছিল৷
টেস্টের শুরুর দিনের কথা কি কিছু মনে আছে আপনার?
মনে না থাকার তো কিছু নেই৷ ওখানে প্রতিটি মোমেন্টই আমাদের জন্য নতুন ছিল৷ অনেক ইমোশোন জড়িত ছিল৷ আমরা টেনশনেও ছিলাম৷ কারণ জীবনে প্রথম টেস্ট খেলবো আর লংগার ভার্সনে আমাদের খুব একটা অভিজ্ঞতাও ছিল না৷ আমরা তখন খুব একটা লংগার ভার্সন খেলিনি৷ শুধু খেলোয়াড় বা টিমই না, সারাদেশই এক ধরনের উত্তেজনার মধ্যে ছিল৷ আমরা যখন মাঠে যাই, তখন দেখি যে তখনকার যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমাদের আগেই মাঠে গিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে আছেন৷ সবাই খুব এক্সসাইটেড ছিল৷ প্রতিটি টেস্টের আগে অফিসিয়াল ছবি তোলা হয়৷ অথচ আমাদের ছবি তোলা হয়নি৷ ফলে আমাদের কোনো অফিসিয়াল ফটোগ্রাফও নেই৷ ডেব্যু হলে প্লেয়ারদের ক্যাপ পরিয়ে দেয়া হয়৷ আমাদের সেটাও দেয়া হয়নি৷ এখন এগুলো দেখি আর মনে হয়, তখন আসলে এ সব ব্যাপারগুলো গোছানো ছিল না৷ ডিসঅর্গানাইজড বলব না, আসলে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল না৷ তখন আমরা সবাই খুব এক্সসাইটেড ছিলাম, তাই এগুলো মিস করে গেছি৷
আপনি কতটা নার্ভাস ছিলেন?
নার্ভাস বলব না, আসলে ইনএক্সপেরিয়েন্সড৷ তবে খানিকটা নার্ভাস হয়ত ছিলাম৷ প্রথম টেস্ট, টস জিতলে আগে কী করব? টসের সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল৷ আগে তো টসের কয়েন ম্যাচ রেফারিরা তুলতেন না৷ আমি কয়েন ছোড়ার পর সৌরভ গাঙ্গুলি বললেন ‘হেড'৷ এবং পরে উনি কয়েন তুলে বললেন যে তিনি জিতে গেছেন৷ আমি তখন ম্যাচ রেফারিকে ডাকলাম৷ তিনি এসে কিন্তু বললেন যে, আসলে আমিই টসে জিতেছি৷ এরকম কিছু ছোট ছোট ঘটনা...৷ আমি নার্ভাস থাকলে তো আর ঐ ঘটনা ঘটত না৷ আমি হয়ত ছেড়ে দিতাম৷
আপনি নিজে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন৷ এটা কি আপনি প্রত্যাশা করেছিলেন?
প্রত্যাশা ছিল না৷ কারণ তখন ইন্ডিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ অনেক স্ট্রং ছিল৷ বলতে গেলে, তখন ইন্ডিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ ছিল৷ তার এগেইনস্টে ৬ উইকেট পাওয়াটা সত্যিই আমি প্রত্যাশা করিনি৷ ভালো বল করার ইচ্ছা ছিল, চেষ্টা ছিল৷ উইকেট পাওয়াটা তো লাকেরও ব্যাপার৷ তারপরও যে উইকেট পেয়েছিলাম, তাতে খুব খুশি হয়েছিলাম৷
সব মিলিয়ে আপনাদের দলীয় পারফরম্যান্স কেমন ছিল?
প্রথম টেস্ট হিসেবে আমি খারাপ বলব না৷ ফাস্ট ইনিংসে তো আমরা ভালোই করেছিলাম৷ সেকেন্ড ইনিংসে ব্যাটিং কল্যাপসটা এখনো হচ্ছে৷ ১৬-১৭ বছর পর এসেও সেকেন্ড ইনিংসটা কেমন যেন ধসে যাচ্ছে৷ ওই সময়কার ইন্ডিয়া টিমের এগেইনস্টে প্রথম টেস্টে ঐ সেকেন্ড ইনিংসটা ছাড়া সবকিছু ভালোই ছিল বলবো৷
বাংলাদেশ তো শততম টেস্ট খেলতে যাচ্ছে কলম্বোতে৷ এই ১৬ বছরে বাংলাদেশ কি যথেষ্ট টেস্ট খেলেছে?
আমি মনে করি শততম টেস্টটা আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল৷ বিভিন্ন সময় আমরা বলেছি টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য৷ আমি মনে করি, ১৬ বা ১৭ বছর পর এসে আমরা অবশ্যই কম টেস্ট খেলেছি৷
এই সময়ে বাংলাদেশের যতটা উন্নতি হওয়া উচিত ছিল, ততটা কি হয়েছে?
উন্নতি হয়নি, এটা বলব না৷ তবে উন্নতি হওয়ার আরো জায়গা আছে৷ আমাদের ডোমেস্টিক ক্রিকেটে লংগার ভার্সনকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে৷ এটাকে আরো প্রতিযোগীতামূলক করলে আমরা আরো ভালো করবো৷ একটা টেস্ট প্লেয়িং জাতির যে ধরনের কালচার থাকা উচিত, সেটাকে আরো উন্নতি করা৷ প্লেয়ার প্রডিউস করার জন্য আমাদের অ্যাকাডেমিগুলোকে আরো তাগিদ দেয়া৷ আমরা যেহেতু বিভিন্ন দেশে গিয়ে টেস্ট খেলি, টেস্টের উইকেট একটু অন্যরকম হয়৷ ওয়ানডেতে পৃথিবীর যে কোনো দেশে গেলে একই রকম উইকেট পাওয়ার সম্ভবনা থাকে৷ কিন্তু টেস্টে যে দেশে খেলা হয়, তারা নিজেদের মতো উইকেট করার চেষ্টা করে৷ আমাদের বিভিন্ন ধরনের উইকেট বানিয়ে খেলার চেষ্টা করতে হবে এবং আমাদের প্লেয়ারদের স্কিল আরো ডেভেলপ করবে৷
আপনি তো সবসময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে টেস্টকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন৷ সেটা কি আমরা দিচ্ছি ঠিকমতো?
এখনো না৷
কারণ কী?
আমার কাছে বাণিজ্যিক কারণটাই বেশি বলে মনে হয়৷ টি-টোয়েন্টি বা একদিনের ম্যাচে দর্শকদের আগ্রহ থাকে৷ স্পনসরদেরও আগ্রহ থাকে বেশি৷ যেহেতু আমরা ক্লাব বেসড ক্রিকেট খেলি, সেখানে ফ্র্যানচাইজি বা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে গিয়ে টি-টোয়েন্টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা৷ কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, লংগার ভার্সন ভালো খেললে তবেই আমরা শর্ট ভার্সন ভালো খেলবো৷ টি-টোয়েন্টি ভালো খেললে কিন্তু লংগার ভার্সন ভালো খেলার স্কোপ নেই৷
আপনি তো ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকও৷ তা ক্রিকেট নিয়ে বোর্ডের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, আপনি একজন বোর্ড পরিচালক হিসেবে কী মনে করেন, বোর্ড কি সে দায়িত্ব পালন করছে?
বোর্ড দায়িত্ব পালন করছে না, সেটা বলব না৷ তবে আরো কিছু এরিয়া আছে....এই যেগুলোর কথা বললাম...৷ আমাদের গ্রাউন্ড, ফেসিলিটি – সবকিছু মিলিয়ে আর একটু জোরে শোরে কাজ করা দরকার৷
ফিরে দেখলে এই ১০০টি টেস্টের মধ্যে কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
অবশ্যই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড, সম্প্রতি আমরা যেটা জিতলাম৷
আপনাকে যদি একটি টিম করতে বলা হয়, যাঁরা এই ৯৯টি টেস্টে অংশ নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে থেকে৷ আপনি কাদের নেবেন দলে?
এটা আসলে চিন্তার বিষয়৷ হুট করে এমন একটা দল করতে গেলে কেউ বাদ পড়তে পারেন৷ তাই এই মুহূর্তে কারুর নাম বলতে পারবো না৷
এখন যাঁরা ক্রিকেট খেলছেন বা সামনে যাঁরা আসবেন, তাঁদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
আমার পরামর্শ হলো – ক্রিকেট খেলাটা নট অনলি এ গেম৷ এটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত৷ খেলাটাকে এনজয় যেমন করতে হবে, রেসপেক্টও করতে হবে তোমনই৷ দিন শেষে ক্রিকেট আমাদের সমাজেও অনেক ভূমিকা রাখে৷ ক্রিকেট আমাদের জাতিকে এক করে৷ কাজেই ক্রিকেটের প্যাশনটাকে ধরে রাখতে হবে৷ এটাকে যাঁরা প্রফেশন হিসেবে নিয়েছেন, তাঁদের টাকা আসবে আর যাবে৷ কিন্তু প্যাশনটা যদি থাকে তাহলে এই খেলার যে চরিত্র, সেটা আমরা মেইনটেইন করতে পারবো৷
বন্ধু, দুর্জয়ের সাক্ষাৎকারটি আপনাদের কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷