খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে সংঘাত, নিহত ৪, ১৪৪ ধারা জারি
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে রাতভর গোলাগুলি হয়।
দুই জেলার সংঘাতে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে সেনাবাহিনীও। দুই জেলাতেই ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। প্রশাসনের উদ্যোগে খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় শুক্রবার দু'টি সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এখনো পরিস্থিতি থমথমে। নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কায় আতঙ্কে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
খাগড়াছড়িতে সংঘাত ও গোলাগুলিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। এদের মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালার বাসিন্দা। অপর দু'জন খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, "রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তাদের বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। বর্তমানে হাসপাতালে আরো ৯ জন চিকিৎসাধীন। চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার রাঙামাটিতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত ও কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। নিহতের নাম পরিচয় জানা যায়নি। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক সাদিয়া আক্তার একজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে তিন পার্বত্য জেলায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ আহ্বান জানানো হয়। বার্তায় বলা হয়েছে, ১৮ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত ও ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসরত জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর।
যেভাবে সংঘাতের সূত্রপাত
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদরের বাসিন্দা সৃজন চিক্কো ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গত বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল চুরি করে পালানোর সময় স্থানীয় লোকজন ধাওয়া দিলে একটি বিদ্যুতের পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার জের ধরে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সেই মিছিল থেকে একজন পাহাড়ির দোকানে ইট ছোঁড়া হয়। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।”
তবে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কাউন্সিলর মুজিবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বুধবার মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে পাহাড়িরা। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা। এই ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালা সরকারি কলেজের বাঙালি শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। সেই মিছিলে হামলা চালায় সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। এরপর দুই পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।”
স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক গগন ত্রিপুরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, " বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়ি-ঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রাণভয়ে পাহাড়িরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।” লারমা স্কয়ার এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মিছিলে পাহাড়িরা কেউ বাধা দেননি। মিছিল থেকেই অতর্কিতভাবে পাহাড়িদের দোকানে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।”
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে। ভাংচুর হয় চারটি দোকান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
তবে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অগ্নিকাণ্ডে ১০৫টি দোকান পুড়েছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৫১টি ও বাঙালিদের ৫৪টি দোকান। এতে এক কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতির উত্তরণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে আমি নিজে এবং জেলা প্রশাসক মো. শহীদুজ্জামান ও দীঘিনালা সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্ণেল ওমর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এলাকার পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন।”
বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালার ঘটনার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলা শহরের নারানখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়। চরম আতঙ্ক আর উদ্বেগের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে খাগড়াছড়িবাসী। সারা রাত ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ, আগুন দেওয়া, গোলাগুলি, হত্যার মতো বিভিন্ন পোস্ট দেখেছে পাহাড়বাসী। এসব পোস্ট দেখে বেশির ভাগ মানুষই ছিলেন ঘুমহীন। সবাই নিজের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রেখেছেন প্রস্তুতি। এমন পরিস্থিতিতে কিছুক্ষণের জন্য সেখানে ইন্টারনেটও বন্ধ রাখা হয় বলে জানিয়েছেন কয়েকজন। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধের কথা স্বীকার করা হয়নি।
ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করা মেজর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। দীঘিনালা ও সদরে দু'টি সম্প্রতি সমাবেশ হয়েছে। খাগড়াছড়িতে আপাতত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই সংঘাত রাঙামাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।”
রাঙামাটি শহরে হামলা-সংঘর্ষ
খাগড়াছড়ির উত্তেজনা ছড়িয়েছে পাশের জেলা রাঙামাটিতেও। জেলা শহরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হামলা-সংঘর্ষে হতাহতের সংবাদ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত ও কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। তবে নিহতের নাম, পরিচয় জানা যায়নি। তবে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক সাদিয়া আক্তার মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় হামলার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি বনরুপা বাজারে গেলে পুরো শহরে গুজব ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক। এ সময় বনরুপা বাজারে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। আগুন দেওয়া হয় একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
পাহাড়িদের ওপর হামলা, শাহবাগ অবরোধ বিক্ষোভ
দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়িদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতা'র ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতার ব্যানারে শতাধিক মানুষ এ অবরোধে অংশ নেন। এর আগে তারা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করেন। এ সময় তারা পাহাড়িদের বাড়ি-ঘর, দোকানপাটে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ের দিকে যান। প্রায় ২০ মিনিট তারা শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখেন। এরপর তারা এলাকা ছেড়ে চলে যান।
বিক্ষোভের আয়োজকদের অন্যতম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সতেজ চাকমা বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। আমরা পাহাড়িরা বারবার বলে এসেছি পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখার কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ওপর এ ধরনের হামলা বারবার সংঘটিত হচ্ছে। আমরা চাই, প্রথমেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালাসহ রাঙামাটি এবং পুরো পাহাড়ে জুম্মদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবিলম্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হোক। অন্যথায় জুম্ম ছাত্রসমাজ রুখে দাঁড়াবেই।”
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালেদ মনসুর বলেন, "পাহাড়ে হত্যার প্রতিবাদে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তারা ১০ মিনিটের মতো সেখানে ছিলেন।”
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের প্রভাব পড়েছে রাঙামাটি জেলাতেও। খাগড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাঙামাটিতে শুক্রবার সকাল থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির সদর উপজেলায় বেলা দুইটা থেকে ১৪৪ ধারা জারির নোটিশ জারি করা হয়েছে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন চন্দ্র রায় স্বাক্ষরিত আদেশে শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে শুক্রবার সকাল থেকে রাঙামাটিতে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনার পর পৌর এলাকায় বেলা একটা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান।