চলে গেলেন কামাল লোহানীও
২০ জুন ২০২০স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি৷ সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে লড়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে৷ দায়িত্ব পালন করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে৷ স্বাধীনতার পরেও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে প্রগতিশীল আন্দোলন জারি রেখেছিলেন তিনি৷ লড়াকু এই মানুষটি এবার হার মানলেন৷ ৮৬ বছর বয়সে মারা গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কামাল লোহানী৷
শনিবার সকালে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷ তার ছেলে সাগর লোহানী সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসকরা তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে মৃত ঘোষণা করেন৷’’
ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাতে ভুগছিলেন কামাল লোহানী৷ ১৭ মে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি৷ পরে তার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ এরপর পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল থেকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তাকে৷
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
কামাল লোহানীর প্রকৃত নাম আবু নাইম মোহা. মোস্তফা কামাল খান লোহানী৷ ১৯৩৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া গ্রামের খান মনতলা গ্রামে তার জন্ম৷ ১৯৫২ সালে তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন৷ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে৷ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এখানেই ইতি ঘটে৷
পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কামাল লোহানী৷ সেখান থেকেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি৷ ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে৷
মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন তিনি৷ দীক্ষা নেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে৷
পরের বছর আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি৷ এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে৷
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন৷ ১৯৬২ সালে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তিনি৷ ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’৷ ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী৷ যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে৷ ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী শিল্পী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন৷
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান৷
১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী৷ ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন৷ পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি৷
সাংবাদিকতায় তিনি কাজ শুরু করেছিলেন দৈনিক মিল্লাত দিয়ে৷ আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন৷ সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদক পান৷ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা পদে ছিলেন তিনি৷
এফএস/এডিকে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)