1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চাষের মাছ: সচেতনতা জরুরি

১৩ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশে মাছ চাষে রীতিমত বিপ্লব হয়েছে৷ বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ জনপ্রতি মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে৷ তবে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই চাষের মাছ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত৷

https://p.dw.com/p/32y9Q
ছবি: DW/M. M. Rahman

ফাতেমা আবেদীন এখনো বাজারে গিয়ে দেশি মাছ খোঁজেন৷ দেশি মাছ বলতে বোঝায় বাংলাদেশের খাল, বিল, পুকুর বা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে যেসব মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো৷

তাঁর কথা, ‘‘দেশি মাছ আর চাষের মাছের মধ্যে পার্থক্য অনেক৷ দেশি মাছের স্বাদই আলাদা৷ তবে এখন রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস – যা বাজারে পাওয়া যায় সবই চাষের৷ এই ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে৷''

বাংলাদেশে এখন বলতে গেলে সব ধরনের মাছই চাষ হয়৷ রুই, কাতলা থেকে শুরু করে টেংরা, পাবদা, কৈ, শিং, মাগুর – সবই চাষ হচ্ছে৷ রাক্ষুসে প্রকৃতির কারণে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ হলেও গোপনে চাষের অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই৷ আকারে ছোট থাকা অবস্থায় তা বাজারে দেশি মাগুর বলে চালানোর অভিযোগ আছে৷

ফাতেমা আবেদীন বলেন, ‘‘এটাই এখন একটা বড় সমস্যা৷ কোনটা চাষের আর কোনটা দেশি মাছ, তা এখন চেনা কষ্টকর৷ আবার অনেক সময় বাজার থেকে কেনা মাছে রান্নার পর উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়৷''

ফাতেমা আবেদীন

বাংলাদেশে চাষের মাছের দাম কম৷ আর এটা অল্প সময়ে বড় হয়৷ ফলে ক্রেতারা যেমন কম দামে এই মাছ পেয়ে কিনছেন, আবার খামারিরাও চাষের মাছে লাভ করেন অনেক বেশি৷ এই লাভ করতে গিয়ে খামারিরা মাছের জন্য নানা ধরনের দেশে ও বিদেশে তৈরি ফিস ফিড, কেমিক্যাল, অ্যান্টিবায়োটিক, ইনজেকশন ব্যবহার করেন৷ এ সব ব্যবহার করতে গিয়ে এসব অপ্রশিক্ষিত খামারিদের অনেকেই নিয়মিত মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরামর্শও পান না৷

খামারিরা সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবাবায়োটিক আর নানা প্রকার ওষুধ ব্যবহার করেন কোনো পরামর্শ ছাড়াই৷ কখনো কখনো ওষুধ বিক্রেতাদের কথাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন৷

খুলনার পাইকগাছার রাশিদুজ্জামান এই চাষের মাছ নিয়ে সামাজিক সচেতনতার কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনি উপকূলীয় এলাকায় লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার মানুষ চাষের মাছ সহজে খেতে চান না৷ কারণ এমন সব খাদ্য দিয়ে এইসব মাছ দ্রুত বড় করা হয়, যা ক্ষতিকর৷ ক্ষতিকর উপাদান অ্যাবজর্ব হওয়ার আগেই মাছ বিক্রি করা হয়৷''

তিনি বলেন, ‘‘ডিলাররা প্যাকেটজাত মাছের খাবার বিক্রি করেন৷ কিন্তু এ সব খাবার উৎপাদন করা হয় পঁচা শামুক, ঝিনুক এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করে, যা বিষাক্ত৷ মুরগি ও মাছ একই সঙ্গে চাষ করা হয়৷ জলাশয়ের উপরে মাচা দিয়ে বা পাশে মুরগি আর পুকুরে বা জলাশয়ে মাছ৷ মুরগি বা হাসের বিষ্ঠা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়৷ মাছের খবার হিসেবে নানা ধরনের বর্জ্যও ব্যবহার করা হয়৷ বাজারে যেসব মুরগি কেটে বিক্রি করা হয় তার নাড়িভুড়ির বর্জ্য, গরু ছাগল জবাই করার পর তার নাড়িভুড়ির বর্জ্যও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷''

রাশিদুজ্জামান

তিনি আরো জানান, ‘‘তেলাপিয়াসহ আরো কিছু মাছ মনোসেক্স করা হয় ব্যবসার জন্য৷ বিশেষ ধরনের খাবার ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় এই কাজে৷ ফলে তেলাপিয়া মাছ এক পর্যায়ে সব পুরষ হয়ে যায়৷ বাজারে পুরুষ তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশি৷ কিন্তু এটা করতে গিয়ে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ বিভিন্ন কোম্পানির পরামর্শেই বিভিন্ন রাসায়নিক এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও মাত্রা নির্ধারণ করেন তারা৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেমন ধরুন মনোসেক্স কালচারের মাধ্যমে কৈ মাছ সব নারীতে রূপান্তর করা হয়৷ আর সব তেলাপিয়া মাছকে পুরুষে রূপান্তর করা হয়৷ এটা চাহিদা এবং ব্যবসার জন্যই করেন খামারিরা৷ আর এ জন্য তারা হরমোন প্রয়োগ করেন৷ তা হতে পারে খাবারের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে৷ কিন্তু এর মাত্রা সঠিক না হলে বা ওই হরমোন দ্রবিভূত হওয়ার আগেই যদি খাবার জন্য মাছ বিক্রি করা হয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হবে৷ আবার মুরগির বিষ্ঠায় নানা ধরনের ক্ষতিকর মাইক্রোসেল থাকে৷ তা যদি মাছের খাবার হয় তাহলে মাছের মধ্যদিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মুরগির খাবার তৈরির অভিযোগ আছে৷ আর সেই মুরগির বিষ্ঠা বা বর্জ্য যদি মাছের খাবার হয় তাহলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মাছের ভেতরেও যাবে৷''

বরিশালের হিজলা উপজেলার মৎস্য চাষি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা মাছের প্যাকেটজাত খাবার ব্যবহার করি৷ আবার ভুট্টা, খৈল, হাড়ের গুড়া, ধানের কুড়া, শুটকিসহ বিভিন্ন উপাদানের মিশেলে তৈরি খাবারও ব্যবহার করি৷ আমাদের টার্গেট থাকে ছ'মাসের মধ্যে বাজারে মাছ বিক্রি করা৷ তবে এ সব খাবার কতটা নিরাপদ তা আমরা জানি না৷ এছাড়া আমরা নানা ধরনের ওষুধ, কেমিক্যাল, ইনজেকশন, হরমোন ব্যবহার করি৷ পরামর্শ করার জন্য মৎস্য কর্মকর্তাদের তেমন পাওয়া যায় না৷ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এগুলো ব্যবহার করি৷''

ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘এখন খামারিরা ব্যবসার বিষয়টি বেশি দেখছেন৷ তাই মাছের খাবারে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে৷ আবার ফিস ফিড যেসব উপাদানে তৈরি হয়, দেখা যায় সেসব খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে৷ ফলে পুরো বিষয়টিই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়৷ আর সবশেষে এগুলো মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে৷''

ওয়াহিদা হক

মাছের রোগ বালাই সারাতে বা প্রতিরোধ করতে এখন খামারিরা নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহার করেন৷ আর জলাশয়ের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে ব্যবহার করেন চুন ও পটাশ৷ কিন্তু এসব কি মাত্রায় এবং কখন ব্যবহার করতে হবে তার জন্য নেই কোনো বিষেষজ্ঞ পরামর্শ৷ খামারিরা চান কম খরচে মাছ উৎপাদন করে ভালো ব্যবসা করতে৷ তাই তারা হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ওষুধ ব্যবহার করেন৷ এইসব ওষুধ আসে বিদেশ থেকে৷ এর মান নির্ধারণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই৷

ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘যেসব কেমিক্যাল জলাশয়ে ব্যবহার করা হবে তা দ্রবীভূত হতে হবে৷ সেটা যদি না হয় তাহলে বিপজ্জনক হবে৷ তাই এর মাত্রা নির্ধারণ খুব জরুরি৷ নয়তো তা মাছে থেকে যাবে৷ সেখান থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল বা ওষুধ ব্যবহারের কারণে অথবা পুকুরে বর্জ্যের কারণে কখনো কখনো মাছে গন্ধ হয়৷ আর স্বাদে তো পার্থক্য হয়ই৷ দেশি মাছের সঙ্গে চাষের মাছের পার্থক্যের কারণ দেশি মাছ স্বাভাবিক নিয়মে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়৷ আর চাষের মাছ কৃত্রিমভাবে দ্রুত বড় করা হয়৷''

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তারা মাছ চাষের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত আছেন৷ অনেকে মুনাফার জন্য হরমোন, ওষুধ এবং কেমিক্যাল বেশি ব্যবহার করেন৷ এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তর চাষিদের সতর্ক করছে৷ তবে লোকবলের অভাবে তা কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না৷

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণ পনিতে চিংড়ি চাষ নিয়ে বিতর্ক আছে শুরু থেকেই৷ পাইকগাছার রাশিদুজ্জামান জানান, ‘‘এ কারণে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ গাছপালা মরে যাচ্ছে৷ গবাদি পশু ও হাস মুরগির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে৷

আর ফাতেমা আবেদীন বলেন, ‘‘বাজার থেকে আমরা যে চাষের মাছ কিনি তার বিক্রেতারাই জানান, এইসব মাছ নানা ধরনের বর্জ্য খাবার খেয়ে বড় হয়েছে৷ কখনো বর্জ্য ফেলার জায়গায় মাছ চাষ হয়৷ ফলে মাছে গন্ধ হয়৷ তারপরও এই মাছই খেতে হচ্ছে৷''

প্রসঙ্গত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নায়ারণ চন্দ্র চন্দ গত ১৭ জুলাই মৎস সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যে, দেশে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ৷ দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৫.৩০ শতাংশ) মৎস্য খাতের অবদান৷ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ ৫০ হাজার টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৪ হাজার টন বেশি৷''

দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশই মৎস্য চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ ২০২০-২১ সাল নাগাদ ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্য আছে বাংলাদেশের৷

প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য